অ্যাজোলা |
অ্যাজোলা, কেউ বলে পানা, দল, ফিচি ইত্যাদি নানা নাম বিভিন্ন এলাকায় চালু আছে। এটি আসলেেএক ধরনের ফার্ন, যাকে আমরা বলি ঢেঁকি শাক বা ঢেঁকড়া। এশিয়া ও আফ্রিকার একাংশে অ্যাজোলার দেখা মেলে। খুব অল্প পানিতেও এটি দ্রুত বাড়তে পারে। এমনকি দশ পনেরো তিনের মধ্যে ছোটখাট একটি পুকুরে একেবারে ছেয়ে যেতে পারে। ধানের জমিতে এটি হলে অনেকে আগাছা মনে করে তুলে ফেলেন। পুকুরে হলেও মনে করেন জঞ্জাল। কিন্তু এর পুষ্টিগুণ ও নানা উপকারী দিক জানলে আপনি নিঃসন্দেহে আদর করে আপনার পুকুর ও জমিতে লালন-পালন শুরু করে দিবেন!
আমিষ (প্রোটিন) ও নানা ভিটামিনে ভরপুর অ্যাজোলা। চাষের ১৫ দিন পর থেকেই গরু, ছাগল, ভেড়া, হাঁস, মুরগিসহ সব ধরনের প্রাণীকেই খাওয়ানো যায়। অ্যাজোলায় ২৫-৩০ শতাংশ প্রোটিন, ১০-১৫ শতাংশ খনিজ, ৭-১০ শতাংশ অ্যামাইনো অ্যাসিড রয়েছে। ফলে এটি খাওয়ালে আপনার খামারে ভিটামিন ও পুষ্টির পেছনে খরচ অনেকখানি কমে যাবে। তবে সংগ্রহের পর অবশ্যই পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে লবণ মাখিয়ে খাওয়াতে হবে।
নির্দিষ্ট কিছু গুণ ও বৈশিষ্ট্যের কারণে অ্যাজোলাকে মসকিটো ফার্ন, ডাকউইড ফার্ন, ফেইরি ফার্ন বা ওয়াটার ফার্ন বলা হয়। এটি মূলত জলজ ঢেঁকিশাক বা ঢেঁকড়া।
অ্যাজোলা অত্যন্ত দ্রুতবর্ধশীল উদ্ভিদ। এ টি ৩-১০ দিনের মধ্যে দ্বিগুণ হযে যায়। পানি জমে থাকা ধানের জমিতে এর উৎপাদন ৮-১০ টন পর্ন্ত হয়। আর প্রতি হেক্টরে অ্যাজোলার উৎপাদন হতে পারে ৩৭.৮ টন, এখান থেকে ড্রাই ম্যাটার মিলবে ২.৭৮ টন।
পানিতে ভাসমান অ্যাজোলা সালোকসংশ্লেষণকারী বা গাছের মতো কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে অক্সিজেন উৎপাদনকারী সাইনোব্যাকটেরিয়ার সঙ্গে চমৎকার মিথোজীবিতা তৈরি করে। এই সাইনোব্যাকটেরিয়াটি আবার বাতাস থেকে নাইট্রোজেন সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করে। ফলে অ্যাজোলা এই ব্যাকটেরিয়া থেকেই তার প্রয়োজনীয় পুষ্টি পায়। এ কারণেই কিন্তু অ্যাজোলাকে “সুপার প্ল্যান্ট” বলে। ব্যাকটেরিয়ার কল্যাণেই অ্যাজোলা দ্রুত বাড়ে এবং বংশবৃদ্ধি করে। একমাত্র অ্যাজোলাতেই মিথোজীবী ব্যাকটেরিয়াটির এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে বংশ পরম্পরায় স্থানান্তরিত হয়। অর্থাৎ সাইনোব্যাকটেরিয়াটি একটা পর্ায়ে গিয়ে সম্পূর্ণ অ্যাজোলার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এতে করে অ্যাজোলার পুষ্টি সরবরাহ নিশ্চিত হয়। আর ধানের জমিতে অ্যাজোলার হলে এই নাট্রোজেনের ভাগ পায় ধান গাছ। ফলে আলাদা করে তখন ইউরিয়া না দিলেও চলে।
ধানের জমিতে সাহায্যকারী উদ্ভিদ হিসেবে অ্যাজোলার ব্যবহার কমপক্ষে এক হাজার বছরের পুরনো ঐতিহ্য। মূলত অ্যাজোলার শিকরে থাকা সাইনোব্যাকটেরিয়ার নাইট্রোজেন সংরক্ষণ ক্ষমতার কারণেই এটি ধানের প্রাকৃতিক ইউরিয়ার উৎস হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তাছাড়া ধানের জমিতে অ্যাজোলা রাখলে এটি দ্রুত বেড়ে এমনভাবে জমিতে ছড়িয়ে পড়ে যে ধান আর কোনো উদ্ভিদ/ঘাস গজাতে পারে না। ঘাস হওয়ার ঠেকাতে অনেক ফসলে মালচিংয়েও অ্যাজোলা ব্যবহার করা হয়। বারবার সেচ দিতে হয় এমন জমির আর্দ্রতা ধরে রাখে।
ধানের জমিতে অ্যাজোলা নিয়মিত সংগ্রহ করাও যায় |
ধান চাষীরা বিশেষ করে চীনের চাষীরা বায়োফার্টিলাইজার (জৈবসার) হিসেবে অ্যাজোলা ব্যবহার করছেন দেড় হাজার বছর আগে থেকে। ধানের জমিতে অ্যাজেলা ব্যবহারের লিখিত রেকর্ড পাওয়া যায় শিয়া সি শুয়ের লেখা দ্য আর্ট অব ফিডিং দ্য পিপল বইয়ে। বইটি লেখা হয় ৫৪০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে। সতোরো শতকের শুরুর দিকে মিং রাজবংশের আমল যখন শেষ হয় তখন নানা রেকর্ডে সবুজ সার হিসেবে অ্যাজোলার ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়।
চৌবাচ্চায় অ্যাজোলা চাষ |
মশার বংশবৃদ্ধি ঠেকাতেও অ্যাজোলার ব্যবহার আছে। আর এ কারণেই এটিকে মসকিটো ফার্নও বলে। ধানের জমিতে অ্যাজোলা থাকলে সেখানে মশার লার্ভা জন্মাতে পারে না। কারণ অ্যাজোলা ঘন কার্পেটের মতো হয়ে যাওয়ার কারণে মশা পানিতে ডিম পাড়তে পারে না। আবার ডিম পাড়লেও লার্ভাগুলো অক্সিজেনের অভাবে মারা যায়।
0 Comments