তসর |
‘রেশম’ শব্দটি ফার্সি ভাষা থেকে এসেছে। ২৬০২ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে সম্রাট হোয়াঁতির চর্তুদর্শী রাণী সি-লিং-চি একটি গাছের নীচে বসে চা খাচ্ছিলেন। সেই সময় একটা রেশমগুটি তাঁর চায়ের কাপে এসে পড়ে। চা খুব গরম ছিল বলে গুটির উপরের আঠাযুক্ত অংশটি গলে যায়। এই গলে যাওয়া গুটি থেকে বেরিয়ে আসে সূক্ষ্ম সোনালী রংয়ের সুতো, তাই এর নাম হয় স্বর্ণসূত্র এবং সি-লিং-চি –র নাম হয় সুতোর রাণী(Queen of Textiles)। চীন এই তুঁত রেশনের মাধ্যমে সমগ্র পূর্ব-পশ্চিম এশিয়া ও ইউরোপে বাণিজ্যের বিস্তার ঘটতে শুরু করে। আর যে পথে এই বাণিজ্য হত তার নাম হয় রেশম পথ বা সিল্ক রুট। এই সিল্ক রোড-এর মাধ্যমে চীনের বেইজিং থেকে ভূমধ্যসাগরের উপকূল হয়ে প্রথমে গ্রিস ও পরে রোমান সাম্রাজ্যে রেশমের ব্যবসা প্রসার লাভ করে । পরবর্তী কালে দক্ষিণে ইয়েমেন, বার্মা ও ভারতবর্ষে এই সিল্ক রোড বিস্তৃতি লাভ করে। এ উপমহাদেশে প্রথম তিব্বত থেকে ভারতবর্ষের হিমালয়ের পাদদেশে রেশম চাষের বিস্তার ঘটে। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে মোঘল সম্রাটদের পৃষ্ঠপোষকতায় তৎকালীন অবিভক্ত বাংলায় রেশমশিল্পের ব্যাপক প্রসার লাভ করে। বাংলাদেশের রাজশাহী জেলা ও ভারতের মালদা ও মুর্শিদাবাদ বেঙ্গল সিল্ক এর প্রধান উৎপাদনস্থল হিসেবে পরিচিত হয়।
তবে বেঙ্গল সিল্ক বা রেশম বলতে চীন থেকে আগত রেশম-কে বোঝায় না। চীন রেশমের আঁতুরঘর হলেও মুর্শিদাবাদেও খ্রীষ্টের জন্মের অনেক আগে থেকেই একপ্রকার রেশমের চাষ হত। এদের বলা হয় অতুঁত রেশম। এর উল্লেখ পাওয়া যায় মনুস্মৃতি, রামায়ণ, মহাভারত, অর্থশাস্ত্রে। প্রাচীন গ্রন্থে এর নাম ‘কীটজ বস্ত্র’। আসলে রেশম দুই ধরনের হয়। তুঁত-রেশম এবং অতুঁত-রেশম। তুঁত রেশমের চাষ মুর্শিদাবাদে পারস্য থেকে আসলেও অতুঁত রেশম চাষ ভরতেই হত। অতুঁত রেশমকে আবার তিনভাগে ভাগ করা হয় - তসর, মুগা, এরি বা এণ্ডি। সতেরো শতকে মুর্শিদাবাদ রেশম এবং রেশম বয়নের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত হয়ে ওঠে। ইংরেজ বণিকরা মুর্শিদাবাদের রেশমের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠে ১৬২১ সালের দিকে। দিল্লি-আগ্রায় মুঘল শাসন যুগ থেকেই মুর্শিদাবাদের প্রশাসনিক গুরুত্ব বাড়তে থাকে। রেশমই এ প্রশাসনিক গুরুত্বের কারণ। ১৬৬০-এর দিকে মুর্শিদাবাদ একটি পরগনা সদর দফতর হিসেবে গণ্য হয়। এসময়েই মুর্শিদাবাদের কাশিমবাজারে ইউরোপীয়রা কুঠি স্থাপন করে। বেঙ্গল সিল্কের টানে ভারতবর্ষের অন্যান্য রাজা-মহারাজারাও বাংলায় পাইক-পেয়াদা-পণ্ডিত পাঠিয়ে রেশম চাষের দীক্ষা নিতেন। কথিত আছে, রেশম চাষের পদ্ধতি ও ব্যবসায় সম্পর্কে হাতে-কলমে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য শেরে মহীশূর টিপু সুলতান মহীশূরের তাঁতিদের পাঠিয়েছিলেন বাংলায়। বাংলা থেকেই পরে উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে গুটিপোকা তার জাল বিস্তার করে, রেশম বিস্তৃত হয়। ততদিনে বাংলায় চীন থেকে আনা রেশম ও বাংলার নিজস্ব রেশম দুটিতেই খ্যাতি অর্জন শুরু করেছে। এই সিল্ক তখন ইউরোপে রপ্তানি করা হতো। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে আসে রেশমের টানে।
এবার জেনে নিই তুঁত রেশম ও অতুঁত রেশমের বৈশিষ্ট্য
তুঁত রেশম মথ বা পলু সম্পূর্ণ গৃহপালিত। তসর, মুগা রেশমের পলু বন্য। একমাত্র তুঁত গাছের পাতাই খায় তুঁত রেশমে পলু-টি। কিন্তু তসর ও মুগা রেশমের পলু ভিন্ন ধরনের গাছের পাতাও খায়। তুঁত রেশমের সুতো খুব সূক্ষ্ম। চীনের রেশমের সঙ্গে মুর্শিদাবাদের রেশমের পার্থক্য হল চীনের রেশম সাদা। নাগকেশর, মাদার, বট ও বকুল গাছের পাতা খায় অতুঁত রেশমের পলু। তবে বর্তমানে শাল, সেগুন, আসান, অর্জুন গাছের পাতা খাইয়ে ছোটনাগপুর-সাঁওতাল পরগনা অঞ্চলে রেশমের চাষ করা হয়। বিভিন্ন গাছের পাতার রং অনুযায়ী রেশমের রং হয়। যেমন নাগকেশর থেকে উৎপন্ন রেশম রং হয় গোধুম বা গমের মত বর্ণযুক্ত, বকুলগাছের পাতা রেশমের রং হয় শ্বেতবর্ণ এবং বটগাছের রেশমের রং হয় ননীর মতন চিকন।
সূত্র: বঙ্গদর্শন
0 Comments