সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

মিশ্র ফসল: এক জমিতে একসঙ্গে কয়েক ফসল চাষ পদ্ধতি

ছবি কৃতজ্ঞতা: উবিনিগ
যাদের চাষাবাদের জন্য জায়গা-জমি কম তাদের জন্যই এ লেখা। জমিতে ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধি মানেই জমির উৎপাদনশীলতা বাড়ানো। আমাদের কৃষকরা সাধারণ এক মৌসুমে একটি জমিতে একটিমাত্র ফসলই রাখেন। এতে টানা তিন মাস বা কোনো ক্ষেত্রে তারও বেশি সময় মাত্র একটি ফসল ফলাতেই ব্যয় হয়ে যায়। কম জমির কৃষকদের জন্য এটি েমোটেও লাভজনক নয়। এতে জমিতে ফসলের নিবিড়তা বাড়ানো অর্থাৎ এক বছরের মধ্যে খুব বেশি ফসল আবাদ করা সম্ভব নয়। এর একটি সহজ সমাধান নিচে আলোচনা করা হলো:

একক ফসলের চাষ না করে দুতিন রকম ফসল বিভিন্ন লাইনে বুনে মিশ্র ফসলের চাষ করা যায়। সেক্ষেত্রে পুরো জমির ফসল একবারে উঠবে না। যে লাইনের ফসল উঠবে সেই লাইনে আবার সেই মৌসুমের ফসল লাগাতে হবে। এটি অনেকটা জঙ্গলে বিভিন্ন উদ্ভিদ একসঙ্গে বেড়ে ওঠার মতো ব্যাপার। এতে ফসলের রোগবালাই, পোকামাকড়ের আক্রমণ কম হয়, জমির উর্বরতা বাড়ে। তাছাড়া একই জমিতে সারাবছর ফলন পাওয়া যায়। এমনকি এক বছরের মধ্যে ৫/৭ রকমের ফসলের ফলন পাওয়া সম্ভব। তবে এক্ষেত্রে কিছু কৌশল অবলম্বন করতে হয়:

একই গোত্রের ফসল একসঙ্গে চাষ করা যাবে না। যেমন: বেগুন ও টমেটো। কারণ দুই ফসলের রোগবালাই ও পোকা একই। ফলে আক্রমণ বেশি হবে। সমান দৈর্ঘ্যের শিকড়যুক্ত ফসল একসঙ্গে চাষ করা যাবে না। তাহলে দুটি ফসলই মাটির একই স্তর থেকে খাদ্য টানবে। এতে কোনোটিরই বৃদ্ধি ভালো হবে না।

কয়েকটি সাথী ফসলের নমুনা:

# বেগুন ও টমেটোর সাথী ফসল – বরবটি/মটর/সয়াবিন/গাজর/পিঁয়াজ, রসুন। (বেগুন ও টমেটো কখনোই একসঙ্গে নয়)।
# ভুট্টার সঙ্গে সয়াবিন/বাদাম/কলাই/অড়হড়।
# তিলের সঙ্গে পাট/মেস্তা/কলা।
# করলার সঙ্গে মরিচ
# ছোলার সঙ্গে তিসি।
# টমেটোর সঙ্গে বাঁধাকপি/রসুন/গাঁদা।
# অড়হরের সঙ্গে মুগ/বাদাম/বাজরা।
# মিষ্টি আলুর সঙ্গে ভুট্টা ও তুলো।
# মাচায় পটল, নিচে মরিচ
# ভুট্টার সঙ্গে মুগ/বরবটি/শাঁকালু/শিম।
# সরিষার সঙ্গে গম, ছোলা।
# জোয়ারের সঙ্গে ভুট্টা।
# টক ঢেঁড়শের সঙ্গে অড়হর।
# সুপারি/নারকেল এর সঙ্গে পেয়ারা/লেবু।
# পেঁপে/কলার সঙ্গে আনারস।
# আম (চারা অবস্থায়) এর সঙ্গে বিভিন্ন সবজি/ডাল শস্য
# আম (বড় অবস্থায়) এর সঙ্গে হলুদ/আদা।
# কলার সঙ্গে মরিচ/তিল/বরবটি।
# বেগুনের সঙ্গে পান। বরোজের জমির চারপাশে ঢেঁড়শ/কলাগাছ লাগালে সাদামাছির আক্রমণ কমে।

এছাড়া কীটনাশক দেয়া বন্ধ করে ফসলে পোকা দমন বা ব্যবস্থাপনার একটি দারুণ উপায় হচ্ছে মিশ্র ফসল চাষ।  ফসলের মিশ্রণ দিয়ে মাটির পুষ্টি রক্ষা, পোকা ব্যবস্থাপনা এবং ফলন বৃদ্ধি সবই সম্ভব হয়। কৃষকের আয়ও ভাল হয়, এবং ফসলের যে ঝুঁকি থাকে তাও সমাধান করা যায়। এক ফসলের ঝুঁকি অন্য ফসল দিয়ে ঠেকানো যায়। সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, মিশ্র ফসলের জমিতে একাধিক অনাবাদী শাক বেড়ে ওঠে যা খেতে সুস্বাদু, পুষ্টিকর এবং বিক্রি করেও আয় করা যায়।

শীতকালীন কিছু মিশ্র ফসল

মুলা ও লাল শাকের মিশ্রণ
পৌষ মাসের শুরুতে লালশাক তোলা হয়। মুলা প্রথমে শাক হিসেবে তোলা হয় পরে সব্জি হিসেবে মাঘ মাসের শেষ পর্যন্ত মুলা উঠানো যায়। এই সময় লালশাক শেষ হয়ে গেলেও মুলা থাকে। এরই সাথে অনাবাদী শাক হেলেঞ্চা ও দণ্ডকলস অনেক দেখা যায়।

মুলা এবং লাল শাক থেকে কৃষকরা খুব কম সময় অথাৎ দেড় মাসের মধ্যে আয় পেতে থাকে। মুলা যখন ছোট থাকে তখন শাক আকারে বাজারে প্রচুর চাহিদা থাকে। কৃষকরা শাক আকারে তখন বাজারে বিক্রি করে।তারপর কয়েক দিন পরে বড় হলে সব্জী হিসাবে বাজারে বিক্রি হয়। ৩৩ শতাংশ (এক বিঘা) জমিতে মুলা শাক ও মুলা থেকে আয় ১৩ হাজার এবং লাল শাক থেকে ৪ হাজার মোট প্রায় ১৭ হাজার টাকা আয় পাওয়া যায়।

পেঁয়াজ, রসুন, ডাটা ও সরিষার মিশ্রণ
মসলা, তেল ও সব্জি ফসলের মিশ্রণ- পেঁয়াজ, রসুন, ডাটা ও সরিষা। চৈত্র মাসের শেষ থেকে পেঁয়াজ ও রসুন উঠানো শুরু হবে। ফাল্গুন মাসে মাঠ থেকে সরিষা ওঠে।শীত মৌসুমে সাধারনত ডাটা সব্জী আকারে ব্যবহার করা হয়।তবে মাঘ ফাল্গুনে ডাটা লাগালে কার্তিক মাসে বীজ হবে।

সাথে বেড়ে ওঠে বথুয়া শাক ও হেঞ্চি শাক।অনাবাদী শাক বথুয়া ও হেঞ্চি শাক শীত মৌসুমে প্রচুর পরিমানে হয়ে থাকে। জমির মালিক ছাড়াও গ্রামের যে কেউ এ গুলো সংগ্রহ করে খেতে পারে। জমির মালিক কিছু বলবে না। আবার গ্রামের অনেক গরীব মানুষ আছে যারা শীত মৌসুমে বথুয়া শাক ও হেঞ্চি শাক বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করে। আর এই শাকের চাহিদাও বেশ ভালো খেতেও অনেক সুস্বাদু।

পেঁয়াজ, রসুন, ডাটা এবং সরিষা মিশ্র চাষে এক বিঘা জমি থেকে এক মৌসুমে পেঁয়াজ ৭ হাজার টাকা,রসুন ৪ হাজার টাকা,ডাটা ২ হাজার টাকা, সরিষা ২ হাজার টাকা আয় হয়। অনাবাদী ফসল থেকেও ১০০০ থেকে ১২০০ টাকা আয় হতে পারে।এই জমিতে আয় হতে পারে ১৬ হাজার ২০০ টাকা।

বেগুন, ধনিয়া ও লালশাক
স্বল্প ও কিছুটা দীর্ঘমেয়াদি ফসল বেগুন, ধনিয়া ও লালশাকের মিশ্রণ।লাল শাক পৌষ থেকে উঠে যায় আর বেগুন চৈত্র-বৈশাখ মাসে বেগুন সংগ্রহ করা হয়। সাথে জমিতে গজে ওঠা অনাবাদী শাক কাঁটানটে ও বথুয়া পৌষ থেকে বৈশাখ মাস পর্যন্ত সংগ্রহ করা যায়।

এক মৌসুমে এক বিঘা জমিতে ২০ থেকে ২২ হাজার টাকার বেগুন সংগ্রহ করা যায়। লাল শাক ২ থেকে ৩ হাজার টাকার সংগ্রহ করা যায়। ধনিয়া এক বিঘা জমি থেকে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকার বিক্রি করা যায়। এবং ১ হাজার থেকে ১২০০ টাকার কুড়িয়ে পাওয়া শাক বিক্রি করা যায়।

দুইয়ের অধিক ফসলের মিশ্রণ
সব্জি ফসল গাজর, পাতাকপি ও টমেটো,মাসলা পেঁয়াজ ও রাই সরিষা এবং মাঝে গেঁদা ফুল। গন্ধ ও রঙয়ের দ্বারা পোকা তাড়াবার ব্যবস্থা। অনাবাদী শাক দণ্ডকলস, কাঁটানটে ও বথুয়া বেড়ে ওঠে এসব জমিতে। পৌষ মাসের শুরুতে গাজর তোলা হয়।মাঘ মাসের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত গাজর উঠানো হয়। ফসল লাগানোর এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে কুড়িযে পাওয়া শাক দণ্ডকলস, কাঁটানটে, বথুয়া শাক তোলা যায়। পাতাকপি বা বাঁধাকপি, টমেটো পৌষ মাস থেকে সংগ্রহ করা যাবে, রাই সরিষা ফাল্গুন মাসে সংগ্রহ করা যাবে, পেয়াজ চৈত্র মাস।

গাজর, টমেটো, রাই সরিষা, পাতাকপি ও পেঁয়াজ মিশ্রভাবে চাষাবাদে একবিঘা জমিতে ২০ থেকে ২২ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব।

অর্থকরি ফসলের মিশ্র ফসল
আলু ও ভুট্টা অর্থকরি ফসল হিসেবে অনেকে এককাট্টা চাষ করেন। পৌষ থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত আলু সংগ্রহ করা যায়। চৈত্র শেষ থেকে বৈশাখ মাসের শেষ পর্যন্ত ভুট্টা উঠানো যায়।

সাথে দণ্ডকলস ও বথুয়া গড়ে ওঠে। অগ্রহায়ণ থেকে চৈত্র/বৈশাখ পর্যন্ত কুড়ানো শাক দণ্ডকলস ও বথুয়া সংগ্রহ করা যায়।এক মৌসুমে,এক বিঘা জমিতে ভুট্টা প্রায় ৯ হাজার ও আলু থেকে আয় হবে প্রায় ১২ হাজার টাকা আয় হয়।

দীর্ঘ মেয়াদি ফসলের সাথে স্বল্প মেয়াদি ফসল
শসা দীর্ঘ মেয়াদি এবং জমির যথেষ্ট ব্যবস্থাপনার দরকার। বাঁশের জাংলা করার খরচও আছে। এক্ষেত্রে কৃষক শসা গাছ বড় হওয়ার আগেই জমিতে লাল শাক লাগিয়ে পৌষ মাস থেকেই আয় করতে পারেন। তখন রোদ পেতেও সমস্যা নেই। এরই মধ্যে হেঞ্চি, হেলেঞ্চা ও কাঁটানটে গড়ে উঠেছে। পৌষ/মাঘ মাস থেকে বৈশাখ/জ্যৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত কুড়ানো হেঞ্চি, হেলেঞ্চা, কাঁটানটে শাক সংগ্রহ করা যায়। আষাঢ় থেকে অগ্রহায়ণ মাস পর্যন্ত শসা সংগ্রহ করা হয়।

লাল শাক ৩ হাজার টাকা ও শসা এক বিঘা জমিতে ১৮ হাজার টাকা সহ মোট আয় হবে ২১ হাজার টাকা প্রায়।বাড়তি আয় প্রায় ১২০০ টাকা আসছে অনাবাদি শাক থেকে।

একাধিক ফসলের ঘন মিশ্রণ
বরবটি, লাল ডাটা, টমেটো ও সরিষার মিশ্রণ। অল্প জমিতে একাধিক ফসল ঘন করে লাগানো যায়। পৌষ মাস থেকে ফাল্গুন মাসের শেষ পর্যন্ত বরবটি তোলা যায়। শীত মৌসুমে সাধারণত ডাটা সব্জী আকারে ব্যবহার করা হয়। তবে মাঘ ফাল্গুনে ডাটা লাগালে কার্তিক মাসে বীজ হবে। পৌষ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত টমেটো সংগ্রহ করা যায়। ফাগুুন মাসে মাঠ থেকে সরিষা ওঠে।

অনাবাদি শাক দণ্ডকলস ও কাঁটানটে পৌষ/মাঘ থেকে বৈশাখ/জ্যৈষ্ঠ মাস সংগ্রহ করা যায়।

এক বিঘা জমিতে বরবটি ৪ হাজার টাকা, লালডাটা ২ হাজার টাকা,টমেটো ৫ হাজার টাকা, সরিষা ৪ হাজার টাকা মিশ্রভাবে চাষ করলে ১৫ হাজার টাকা আয় হয়।

আরো পড়ুন: সাথি ফসল বলতে কী বুঝায়? কীভাবে চাষ করে
আরো পড়ুন: ৫ হাজার বছর আগের বিস্ময়কর কৃষি প্রযুক্তি
সূত্র: উবিনিগ

Post a Comment

0 Comments