সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

ফসলের উফসী ও হাইব্রিড জাত বলতে কী বুঝায়

উফসী ও হাইব্রিড জাতের মধ্যে পার্থক্য
হাইব্রিড জাতের ধান
ফসলের উফশী জাত বলতে মূলত উচ্চফলনশীল জাতকেই বুঝায়। এটি অন্তঃপ্রজননে সৃষ্ট জাত, ইংরেজিতে বলে ‘ইনব্রিড’ (Inbred)। একই জিনগত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জাতের মধ্যে মিলন বা পরাগায়নে যে প্রজন্ম তৈরি হয় সেটিকে বলে ইনব্রিড জাত। এ ধরনের উন্নত জাত পেতে চাইলে দীর্ঘদিন অর্থাৎ কয়েক প্রজন্ম অপেক্ষা করতে হতে পারে। আবার এ ধরনের প্রজননে সমস্যাও থাকে। একটি ‍উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে: ধরা যাক আপনার বাড়িতে একটি গাভী দিনে ২০ লিটার দুধ দেয়। আপনি জাতটি সংরক্ষণের জন্য কৃত্রিম প্রজনন না করে ওই গাভীর এঁড়ে বাছুরটি বড় করে সেটিকেই বীজ ষাঁড় হিসেবে ব্যবহার করতে থাকলেন। পরবর্তীতে সর্বশেষ দুই প্রজন্মের মধ্যে প্রজনন ঘটাতে থাকলেন। তাতে আপনার জাতটি আরো পরিশুদ্ধ হতে থাকলো। কিন্তু একটা সময় গিয়ে নানা জটিলতায় পড়তে পারেন। যেমন: শারীরিক সমস্যা নিয়ে বাছুরের জন্ম, জন্মের আগেই মারা যাওয়া, গর্ভপাত, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম এমন প্রজন্মের জন্ম ইত্যাদি।

এরকম ঘটার প্রধান কারণ জীবের মধ্যে দুই ধরনের জিনগত বৈশিষ্ট্য থাকে। একটি প্রকট অপরটি প্রচ্ছন্ন। এখন একই রক্ত সম্পর্কীয় (একই জিনগত বৈশিষ্ট্য) জাতের মধ্যে প্রজনন ঘটাতে থাকলে ওই প্রচ্ছন্ন বৈশিষ্ট্য প্রকট হয়ে যেতে পারে। আর মূলত জিনগত সমস্যাগুলো প্রচ্ছন্ন বৈশিষ্ট্যের মধ্যেই সুপ্ত থাকে। এ কারণে রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে বিয়েসাদিকে নিরুৎসাহিত করা হয়। যেমন: মামাতো-খালাতো বা চাচাতো ভাই-বোনের মধ্যে বিয়ে হলে সন্তানের জিনগত সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

এবার আসি ফসলের কথায়। উফসী জাত মানেই যেহেতু ইনব্রিড ফসল সেহেতু নিজেই এটির বীজ সংগ্রহ করে বারবার আবাদ করলে ক্রমেই ফলন কমে আসার সম্ভাবনা থাকে। পাশাপাশি রোগাবালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণও বেশি হতে পারে। আমাদের দেশীয় জাতের ইনব্রিডের মাধ্যমে অনেক উফসী জাত উদ্ভাবন করেছে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) এবং কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি)।

বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর পেছনে হাইব্রিড ও জিনগতভাবে পরিবর্তিত (জেনেটিক্যালি মডিফায়েড- জিএম) জাতের বেশি ভূমিকা রয়েছে। একমাত্র ব্যতিক্রম বাংলাদেশ, যেখানে দেশীয় জাত থেকে উফশী জাত উদ্ভাবন করে তা কৃষকদের হাতে তুলে দিয়েছে। বন্ধা নয়, অর্থাৎ ধান থেকে বীজ-ধান হয়, এমন ৬৪টি জাতের ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন ব্রির বিজ্ঞানীরা। বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা উদ্ভাবন করেছেন ১০টি জাত।

এবার আসা যাক হাইব্রিড ফসলের কথায়। হাইব্রিডের সরল বাংলা সংকর। অর্থাৎ আলাদা দুটি জাতের মধ্যে মিলন বা পরাগায়ন ঘটিয়ে নতুন জাত উদ্ভাবনকেই বলে সঙ্করায়ন। সঙ্করায়নের ক্ষেত্রে নতুন জাতের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত বৈশিষ্ট্য পেতে বাছাইকৃত জাতের মধ্যে মিলন বা পরাগায়ন ঘটানো হয়। যেমন: ভেড়া আর ছাগলের মধ্যে সংকরায়ন ঘটিয়ে গাড়ল, গাধা আর ঘোড়ার সংকরে খচ্চর এরকম নতুন জাত উদ্ভাবন। ফসলের ক্ষেত্রেও এরকম লবণসহনশীল, খরা সহনশীল ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জাত। তবে হাইব্রিড ফসলের জাত উদ্ভাবনের সময় ফলনের দিকটিও বিবেচনায় রাখা হয়। অর্থাৎ হাইব্রিডে উফসী বৈশিষ্ট্যও থাকে।

ব্রি উদ্ভাবিত ধানের বর্তমান জাতের সংখ্যা ৬৫টির বেশি। এর মধ্যে ৬১টি ইনব্রিড (উফশী) এবং ৪টি হাইব্রিড। ইনব্রিড (উফশী) ও হাইব্রিড ধানের মধ্যে প্রধান পার্থক্য হলো, ইনব্রিড ধান থেকে ফসল কাটার পর বীজ রাখা যায়, কিন্তু হাইব্রিড ধান থেক বীজ রাখা যায় না অর্থাৎ এসব বীজ হয় সাধারণত বন্ধ্যা। তাছাড়া গবেষণাগারে খুবই নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে হাইব্রিডাইজেশন ঘটানো হয়। ফলে কৃষকের জমিতে উন্মুক্ত স্থানে পরাগায়নে যে বীজ উৎপাদন হয় তাতে আসল বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ন থাকে না।

আধুনিক জাত: উফসী জাতেই যখন সার/খাদ্য গ্রহণ ক্ষমতা অধিক এবং ফলন বেশি হয় তখন তাকেই বলে আধুনিক জাত। উফশী জাতে যখন প্রয়োজনীয় বিশেষ গুনাগুণ, যেমন রোগবালাই প্রতিরোধক্ষমতা, স্বল্প জীবনকাল, চিকন চাল, খরা-সহিষ্ণুতা ইত্যাদি সংযোজিত হয় তখন তাকে আধুনিক জাত বলা হয়। তাই সকল উফশী জাত আধুনিক নয়, কিন্তু সব আধুনিক ধানে উফশী জাতের গুণ বিদ্যমান।

[ফসল চাষের উন্নত পদ্ধতি]

আমাদের দেশের কৃষকরাও উফসী ও আধুনিক জাতের ধান উদ্ভাবন করেছেন। অনেকে এখনো নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন করে যাচ্ছেন। যেমন: উত্তর-পূর্বের শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী উপজেলার এক অজপাড়াগাঁয়ের সেন্টু কুমার হাজং এবং আরেকজনের বাস দক্ষিণাঞ্চলের বরগুনা জেলার পাথরঘাটার  মীর আবদুল আজিজ।  এরাও ভিন্ন ভিন্ন দুটি জাতের সংকরায়ন ঘটিয়ে নতুন জাত উদ্ভাবন করেছেন। রাজশাহীর তানোর উপজেলার গোল্লাপাড়া গ্রামের নূর মোহাম্মদ আরেকজন উদ্ভাবক। এর জন্য তিনি রাষ্ট্রপতি পুরস্কারও পেয়েছেন। তার উদ্ভাবিত অন্তত ২০০টি জাত রয়েছে। আরেক বিশেষ জাতের উচ্চ ফলনশীল ধান ‘হরি ধান’। বাংলাদেশের কৃষক বিজ্ঞানী হরিপদ কাপালী এই ধানের আবিষ্কারক। ঝিনাইদহ জেলার অনেক জমিতে এখন এই ধান চাষ হচ্ছে।

Post a Comment

0 Comments