আলুর ক্ষেত |
বাংলাদেশে আলু সাধারণত সবজি হিসেবে খাওয়া হয়। মাছ মাংসসহ বিভিন্ন তরকারির সাথে খেতে অনেকে খুবই পছন্দ করেন। বিদেশে আলুর অন্যতম দামি একটি খাবার ফ্রেঞ্চফ্রাই। এছাড়া আলু শুকিয়ে বা বেক করে চিপস বা পাঁপড় বানিয়ে খাওয়ার ব্যাপক প্রচলন রয়েছে। আলু একটি স্টার্চ প্রধান খাদ্য এবং ভাতের বিকল্প হিসেবে খাওয়া যেতে পারে। পৃথিবীর অন্তত ৪০টি দেশে আলু মানুষের অন্যতম প্রধান খাদ্য।
বাংলাদেশে থেকে প্রক্রিয়াজাত আলু বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। তবে উপযুক্ত জাত উদ্ভাবন, মাটির গুণাগুণ ও উন্নত চাষ পদ্ধতি অনুসরণে ঘাটতি থাকায় বাংলাদেশে উৎপাদিত আলুর বিদেশে তেমন চাহিদা নেই। এর প্রধান কারণ এদেশের আলুতে জলীয় অংশ অনেক বেশি থাকে। এ কারণে বিভিন্ন শিল্পে ব্যবহৃত স্টার্চ (আঠা, মাড়) তৈরিতে এট উপযুক্ত নয়।
আলু একটি স্বল্পমেয়াদি উচ্চফলনশীল ফসল যা জমির স্বল্পতাহেতু বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে সহায়তা করতে পারে। বর্তমানে বাংলাদেশ আলু হেক্টরপ্রতি গড় ফলন মাত্র ১১ টন। আলুর উৎপাদন ২০ টন পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব। ফলন বাড়লে উৎপাদন খরচ কমে আসবে।
আলুর জাত নির্বাচন
ভালো জাতের আলুর চাষ করলে চাষি আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারেন। তাই জাত নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে যেসব জাতের আলুর চাষ হয়ে থাকে তা হলো দেশী জাত এবং উচ্চফলনশীল জাত। বর্তমানে আলু চাষের মোট জমির শতকরা ৬৫ ভাগ জমিতে উন্নত জাতের আলু এবং ৩৫ ভাগ জমিতে দেশী জাতের আলুর চাষ হয়ে থাকে।
দেশী জাত
ফলন কম হলেও দেশী জাতের বৈশিষ্ট্য হলো দীর্ঘদিন ঘরেই সংরক্ষণ করা যায়। দেশী জাতের আলু ছোট ও ওজন ৫ থেকে ৪৮ গ্রাম। কিছু দেশী জাত আছে যা উন্নত জাতের চেয়ে নাবি (দেরিতে লাগানো যায়)। দেশী জাতের আলু তুলনামূলকভাবে খেতে বেশি সুস্বাদু। বর্তমানে বাজারমূল্যে উন্নত জাতের চেয়ে দেশী জাতের আলু বেশি দামে বিক্রি হয়। দেশী জাতসমূহের মধ্যে আউশা, চল্লিশা, দোহাজারী লাল, ফেইন্তাশীল, হাসরাই, লাল পাকরী, লালশীল, পাটনাই, সাদা গুটি, শীল বিলাতী, সূর্যমূখী, জাম আলু ইত্যাদি। দেশী জাতগুলো বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। দেখা গেছে ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়ে দেশী জাতের আলুর ফলন কমে যায়। বীজের মাধ্যমেই এ রোগটি ছড়িয়ে থাকে। তাই দেশী জাত নির্বাচনের ক্ষেত্রে রোগমুক্ত বীজ সংগ্রহ করে লাগানো উচিত।
উচ্চফলনশীল
১৯৬০ সাল থেকে এ পর্যন্ত যেসব উন্নত জাতের আলুর চাষ হচ্ছে তার মধ্যে হিরা, আইলসা, পেট্রোনিস, মুল্টা, ডায়ামন্ট, কার্ডিনাল, মন্ডিয়াল, কুফরী সিন্দুরী, চমক, ধীরা, গ্রানোলা, ক্লিওপেট্রা ও চিনেলা জাত সবচেয়ে বেশি চাষ হয়। বারি টিপিক্রস-১ এবং বারি টিপিক্রস-২ নামে ২টি হাইব্রিড জাতের আলু বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) থেকে উদ্ভাবন করা হয়েছে। এছাড়াও বারি আলু-১ (হীরা), বারি আলু-৪ (আইলসা), বারি আলু-৭ (ডায়ামন্ট), বারি আলু-৮ (কার্ডিনাল), বারি আলু-১১ (চমক), বারি আলু-১২ (ধীরা), বারি আলু-১৩ (গ্রানোলা), বারি আলু-১৫ (বিনেলা), বারি আলু-১৬ (আরিন্দা), বারি আলু-১৭ (রাজা), বারি আলু-১৮ (বারাকা), বারি আলু-১৯ (বিন্টজে) এবং বারি আলু-২০ (জারলা) জাত রয়েছে। এসব জাত বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা থেকে উদ্ভাবিত। এগুলো সবই উচ্চফলনশীল জাত।
উৎপাদন পদ্ধতি
বাংলাদেশের কৃষকরা নানা পদ্ধতিতে আলু চাষ করেন, তবে কোনোটিই বিজ্ঞানসম্মত নয়। বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে আলু চাষ, সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করলে একদিতে যেমন ফলন বাড়তো তেমনি মৌসুমে কৃষকদের কম দামে লোকসান দিয়ে আলু বিক্রি করতে হতো না।
মাটি নির্বাচন
আলু চাষের জন্য বেলে দো-আঁশ মাটি সবচেয়ে উপযোগী।
উৎপাদন মৌসুম
বাংলাদেশে সাধারণত নভেম্বর মাসের আগে আলু লাগানো যায় না, কারণ এর আগে জমিতে প্রচুর রস থাকে, জো না আসায় জমি তৈরি সম্ভব হয় না। আবার নভেম্বরের পরে আলু লাগালে ফলন কমে যায়। এ জন্য উত্তরাঞ্চলে মধ্য-কার্তিক (নভেম্বর প্রথম সপ্তাহ), দক্ষিণাঞ্চলে অগ্রহায়ণ ১ম সপ্তাহ থেকে ২য় সপ্তাহের (নভেম্বর মাসের মধ্য থেকে শেষ সপ্তাহ) মধ্যে আলু লাগানো হয়।
বীজের হার
প্রতি হেক্টরে ১.৫ টন। রোপণের দূরত্ব ৬০x২৫ সে. মি. (আস্ত আলু) এবং ৪৫x১৫ সে. মি. (কাটা আলু)। কৃষকেরা ঘরে সংরক্ষিত দেশী জাতের যে বীজ ব্যবহার করেন তার মান ভালো থাকে না। এসব বীজ থেকেই পরে ভাইরাস ও ছত্রাকজনিত রোগ ছড়াই। কোনো কোনো সময় হিমাগারে থাকা অবস্থায় আলুর মাঝখানে কাল দাগ দেখা যায়। মাঠে থাকা অবস্থায় বা সংরক্ষণের সময় যদি উচ্চ তাপমাত্রায় (৩৫ ডিগ্রি সে. এর উপরে) থাকে বা সংরক্ষণের সময় যথেষ্ট অক্সিজেন না পায় তাহলে এমনটি হয়। এ রোগটিকে ব্ল্যাকহার্ট রোগ বলে। আবার যদি হিমাগারের তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে চলে যায় তাহলে আলু শীতলাঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ধরনের আলু গজাবে না। তাই কৃষক অবশ্যই এদিকটা বিবেচনা করে আলু বীজ সংগ্রহ করবেন।
বীজ শোধন
যদি সম্ভব হয় আলু বীজকে মারকিউরিক ক্লোরাইড এক গ্রাম নিয়ে ২ লিটার পানিতে মিশিয়ে ১-২ ঘণ্টা ডুবিয়ে নিলে ভালো হয়। আবার বোরিক এসিডের ০.৫% দ্রবণে আলু বীজ ১৫-৩০ মিনিট ডুবিয়ে রাখলেও ভালো ফল পাওয়া যায়। এতে অন্তত বীজবাহিত ছত্রাকজনিত রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। তবে কাটা বীজ বা গজানো বীজ শোধন করা যাবে না। কাটা বীজ রোদের মধ্যে রাখা যাবে না। তাতে দ্রুত রস শুকিয়ে বীজের গজানো হার কামে যাবে। কাটা অংশে ছাই লাগিয়ে দিলে এ সমস্যা হবে না।
বীজের আকার
২৫-৩৫ গ্রাম ওজনের বীজ রোপণ করা সবদিক থেকে ভালো।
সারের পরিমাণ
কৃষকেরা যদি আলুর উচ্চফলন পেতে চান তাহলে সুষম সারের বিকল্প নেই। সাধারণ কৃষকের জন্য আলু চাষে নিম্নোক্ত হারে সার ব্যবহার করা প্রয়োজন।
ইউরিয়া - ২২০-২৫০ কেজি/হেক্টর
টিএসপি - ১২০-১৫০ কেজি/হেক্টর
এমওপি - ২২০-২৫০ কেজি/হেক্টর
জিপসাম - ১০০-১২০ কেজি/হেক্টর
জিংক সালফেট - ৮-১০ কেজি/হেক্টর
ম্যাগনেসিয়াম সালফেট - ৮০-১০০ কেজি/হেক্টর
(অম্লীয় বেলে মাটির জন্য)
বোরন - ৮-১০ কেজি/হেক্টর
গোবর - ৮-১০ টন/হেক্টর
জমিতে যদি সবুজ সার প্রয়োগ করা হয় তাহলে গোবরের প্রয়োজন নেই।
সার প্রয়োগ পদ্ধতি
গোবর, অর্ধেক ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি, জিপসাম ও জিংক সালফেট আলু রোপণের আগেই মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। বাকি অর্ধেক ইউরিয়া ৩০-৩৫ দিন পর যখন আলুর নালা তৈরি করে মাটি তোলার সময় দিতে হবে।
জলবায়ু
আলু চাষের জন্য তাপমাত্রা ও আলোর প্রভাব খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দেখা গেছে ১৫ ডিগ্রি - ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস গড় তাপমাত্রা আলু চাষের জন্য খুবই উপযোগী। ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার ওপরে গেলে ফলন কমতে থাকে, আবার ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে আলু উৎপাদন ক্ষমতা একেবারে থাকে না। আবার ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার নিচে গেলে গাছের বৃদ্ধি কমে যায়। এজন্য আলু লাগানোর সময় ২০ ডিগ্রি - ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। এ তাপমাত্রায় গাছ দ্রুত গজায়। আবার বাংলাদেশে দেখা গেছে যে বছর মেঘমুক্ত আকাশ ও তাপমাত্রা সঠিকভাবে থাকে সে বছর আলুর গড় ফলন ১০-১৫% বেড়ে যায়।
সেচ
আলু শীতকালীন সবজি। আর শীতকাল শুষ্ক এজন্য আলু চাষে সেচের প্রয়োজন হয়। পানির প্রাপ্যতা কম হলে আলুর ফলন মারাত্মকভাবে কমে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, বীজ আলু বপনের ২০-২৫ দিনের মধ্যে একবার সেচ দিতে হবে। ৪০-৪৫ দিনের মধ্যে দ্বিতীয় সেচ এবং ৬০-৬৫ দিনের মধ্যে আরেকটি সেচ দিতে হবে। এতে ভালো ফল পাওয়া যায়। তবে দেশের উত্তরাঞ্চলে ৮-১০ দিন পর সেচ দিলে ফলন বেশি পাওয়া যায়।
পরিচর্যা
আলু লাগানোর ৩০-৩৫ দিন পর গোড়ায় মাটি দেয়া দরকার এবং সেই সাথে আগাছা দমন করতে হবে। দুই ধাপে গোড়ায় মাটি দিলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
রোগ ও পোকামাকড়
আলু মাঠে থাকা অবস্থায় বিভিন্ন রোগ দেখা যায়। এর মধ্যে আলুর মড়ক রোগ, আলুর আগাম রোগ যা পাতা পোড়ানো বা কুঁচকে যাওয়ার মতো দেখায়, কাণ্ড ও আলু পচা রোগ, ঢলে পড়া ও বাদামি পচন রোগ, আলুর দাঁদ রোগ, আলুর মোজাইক রোগ, আলুর শুকনো পচা রোগ, আলুর নরম পচা রোগ অন্যতম।
রোগমুক্ত বীজ ব্যবহার করতে হবে। রোগ দেখা দিলে সেচ দেয়া বাদ রাখতে হবে এবং উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার সাথে পরামর্শ করে বালাইনাশক দিতে হবে।
পোকামাকড় দমন
আলু ক্ষেতে বিভিন্ন ধরনের পোকামাকড় দেখা যায়। এদের মধ্যে আলুর কাটুই পোকা অন্যতম। এ পোকার কীড়া বেশ শক্তিশালী ৪০-৫০ মিমি লম্বা হয়। এ পোকা চারা গাছ কেটে দেয় এবং আলুতে ছিদ্র করে এজন্য আলুর ফলন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কাটুই পোকার প্রকোপ বেশি না হলে কাটা আলু গাছ দেখে তার কাছাকাছি মাটি উলটপালট করে কীড়া খুঁজে বের করে মেরে ফেলতে হবে। এছাড়াও প্রতি লিটার পানির সাথে ডারসবান ২০ ইসি ৫ মিলি হারে মিশিয়ে গাছের গোড়া ও মাটি ভিজিয়ে ৩০-৪০ দিন পর স্প্রে করতে হবে। আলুর সুতলি পোকা ও আলু উৎপাদনে বাধাগ্রস্ত করে। এ পোকা দেখতে ছোট, ঝালরযুক্ত, সরু ডানা বিশিষ্ট ধূসর বাদামি রঙের হয়ে থাকে। পূর্ণাঙ্গ পোকা সাদাটে বা হাল্কা গোলাপি বর্ণের এবং ১৫-২০ মিমি লম্বা হয়। এ পোকা আলুর মধ্যে লম্বা সুড়ঙ্গ করে আলুর ক্ষতি করে থাকে। কৃষকের বাড়িতে রাখা আলু এ পোকা দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
দমন
বাড়িতে রাখা আলুতে শুকনা বালি, ছাই, তুষ অথবা কাঠের গুঁড়ার পাতলা স্তর দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। যাতে পোকা আলুর সংস্পর্শে না আসে। আলু সংরক্ষণের পূর্বে সুতলী পোকায় খাওয়া আলু ফেলে দিতে হবে।
ফসল সংগ্রহ
আলু পরিণত হলে আলু গাছের কাণ্ড হেলে পড়ে এবং নিচের দিকের পাতা হলুদ হতে থাকে। আলু সংরক্ষণ করতে হলে অবশ্যই পরিপক্বতা লাভ করার পর ফসল সংগ্রহ করতে হবে। উচ্চফলনশীল জাতে ৮০-১০০ দিন লাগে পরিপক্বতা আসতে। দেশী জাতে সময় আরো বেশি লাগে। বাংলাদেশে উচ্চফলনশীল জাতের হেক্টরপ্রতি ফলন ১৩-১৪ টন এবং দেশী জাতে ৭-৮ টন। বৈজ্ঞানিক উপায়ে চাষ করলে উচ্চফলনশীল জাতে ২০ টনের অধিক ফলন পাওয়া সম্ভব।
[আলু সংগ্রহে সতর্কতা ও দেশীয় পদ্ধতিতে সংরক্ষণ]
তথ্যসূত্র : সবজি বিজ্ঞান (ড. মোহাম্মদ মামুনুর রশিদ), বারি হ্যান্ডবুক
0 Comments