সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

বায়োফ্লক পদ্ধতি নিয়ে কিছু কথা

বায়োফ্লক ট্যাঙ্ক
বায়োফ্লক সিস্টেম

বায়োফ্লক হলো এমন এক সৃজনশীল ও সাশ্রয়ী উদ্ভাবনী আইডিয়া, এ প্রযুক্তিতে মাছ ও চিংড়ি বা কাঁকড়া, শামুকের জন্য বিষাক্ত বস্তু যেমন নাইট্রেট, নাইট্রাইট, অ্যামোনিয়া পুষ্টিকর খাদ্যে রূপান্তরিত হয়। এ খাদ্যে প্রচুর প্রোটিন বা আমিষ থাকে। এ পদ্ধতিতে চৌবাচ্চা বা বড় ট্যাঙ্কে খুব কম পরিমানে বা একেবারেই পানি পরিবর্তন না করে মাছ চাষ করা যায়। যথেষ্ট এয়ারেশন বা বাতান্বয় রাখা গেলে এবং প্রচুর পরিমানে বায়োফ্লক তৈরি করা গেলে এ খামারে অনেক বেশি ঘনত্বে মাছ চাষ করা যায়। তবে বায়োফ্লক কালচারের হার বাড়াতে চাইলে ট্যাঙ্কটিতে সরাসরি রোদ পড়তে হবে। সরাসরি রোদ ছাড়া ঘরের ভেতরেও এ পদ্ধতিতে মাছ চাষ করা যায়। তবে সেক্ষেত্রে উৎপাদন কম হতে পারে।


বায়োফ্লক ব্যবস্থায় যা যা দরকার
পরিবেশের ওপর কোনো বিরূপ প্রভাব না ফেলেই মৎস্য চাষ করাই হলো বায়োফ্লক পদ্ধতি উদ্ভাবনের মূল্য লক্ষ্য। এ পদ্ধতিতে আলাদা কোনো জলাশয়ের প্রয়োজন হয় না। পানির অপচয় হয় না বললেই চলে, দীর্ঘমেয়াদে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করতে হয় না। 

মৎস্য চাষের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ খাবারের পেছনে খরচ। প্রচলিত পদ্ধতিতে উৎপাদন খরচের ৬০%-ই চলে যায় খাদ্যের পেছনে। তাছাড়া লাভজনক হওয়ার কারণে অনেকে আবাদি জমি খুঁড়ে পুকুর করেন। এটি আমাদের সীমিত চাষযোগ্য জমির জন্য বড় হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। 

বেশি ঘনত্বে চাষ করতে চাইলে এবং মৎস্য চাষে পানি শোধন খুব জরুরি। ফলে প্রচুর পানির অপচয় হয়। কিন্তু বায়োফ্লক সিস্টেমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এতে বারবার পানি শোধনের কোনো দরকার নেই।

বায়োফ্লক সিস্টেমের মূল কৌশলটিই হলো, পানিতে বিভিন্ন ধরনের অণুজীব তৈরির মাধ্যমে উচ্চ কার্বনঃনাইট্রোজেন অনুপাত বজায় রেখে একটি নাইট্রোজেন চক্র তৈরি করা। ফলে নাইট্রোজেন বর্জ্য (অতিরিক্ত খাদ্য, মাছের মল ইত্যাদি) মাছের খাদ্যে রূপান্তরিত হয়।
বায়োফ্লক সিস্টেম ডায়াগ্রাম
সিস্টেম ডায়াগ্রাম
বায়োফ্লক সিস্টেমে উচ্চ কার্বনঃনাইট্রোজেন অনুপাত বজায় রাখা হয় নিয়মিত কার্বোহাইড্রেড সোর্স প্রয়োগ করে। এর জন্য ঝোলাগুড় বা স্টার্চ জাতীয় জিনিস যেমন, চাল, গম ফার্মেন্ট (গাঁজন) করে প্রয়োগ করা হয়। উচ্চমানের এককোষী প্রোটিন অণুজীব ব্যাপকভাবে তৈরি হওয়ার ফলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পানির গুনাগুন ঠিক থাকে। এ পরিবেশের মধ্যে বিপুল পরিমাণ অণুজীব তৈরি হয় যারা পানির গুনগত মান ঠিক রেখে নিজেরাই প্রোটিনের বড় উৎসে পরিণত হয়ে একটি বায়ো রিঅ্যাক্টরের মতো কাজ করে। তবে এক্ষেত্রে প্রচুর এয়ারেশনের প্রয়োজন হয়। কারণ পানিতে অক্সিজেনের অভাব হলে অতিমাত্রায় অ্যামোনিয়া ও মিথেন তৈরি হবে। এতে দ্রুত মাছ মারা যাবে।

বায়োফ্লক পদ্ধতির জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত হলো চিংড়ি। কারণ এরা জলাশয়ের তলদেশে থাকে। ফলে পরিবেশের পরিবর্তনে খুব একটা প্রভাবিত হয় না। তবে নীল তেলাপিয়াও চাষ করা যায়। এ পদ্ধতিতে প্রচলিত পদ্ধতির মাছ চাষের তুলনায় চিংড়ির বৃদ্ধি কয়েকগুণ বেশি হয়।

বায়োফ্লকের পুষ্টিগত গুরুত্ব

একটি বায়োফ্লক সিস্টেমে থাকে বিভিন্ন ধরনের কণা এবং নানা প্রজাতির অণুজীব। এরা আবার বিশেষ জৈবযৌগ নিঃসরণ করে। পুরো সিস্টেমের মধ্যে অণুজীবের মধ্যে থাকে ব্যাকটেরিয়া, শৈবাল, ছত্রাক, ক্ষুদ্র অমেরুদণ্ডী প্রাণী, মৃত কোষ ইত্যাদি। এরা প্রোটিন সমৃদ্ধ মৎস্যখাদ্য। মূলত অব্যবহৃত খাদ্যের রূপান্তর এবং সূর্যের আলোর সংস্পর্শে প্রাকৃতিকভাবে খাদ্য তৈরি হয়। এখানে ফ্লকগুলো একে অপরের সাথে লেগে থেকে ফিতার মতো আকৃতি নেয়। মূলত ব্যাকটেরিয়ার নিঃসৃত আঠালো তরল (মিউকাস) এবং ফিতাকৃতির অণুজীব অথবা বৈদ্যুতিক আকর্ষণের কারণে তারা এমন আকৃতি নেয়। বড় ধরনের ফ্লকগুলো খালি চোখেই দেখা যায়। তবে বেশিরভাগই আণুবীক্ষণিক, আকার ৫০-২০০ মাইক্রন।

বায়োফ্লক সিস্টেমের নিউট্রিশনাল ভ্যালু বেশ সন্তোষজনক। একটি উপযুক্ত সিস্টেমে ২৫-৫০% প্রোটিন এবং ০.৫-১৫% ফ্যাট বা চর্বি থাকে। এতে প্রচুর ভিটামিন ও মিনারেল (খনিজ) থাকে বিশেষ করে ফসফরাস। অণুজীবগুলো প্রোবায়োটিকের কাজও করে। মৃত ও শুষ্ক বায়োফ্লকগুলো ফিশমিল বা সয়াবিন ফিডের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যায়। যদিও এটির সাশ্রয়ী কোনো উপায় উদ্ভাবন আজও হয়নি।
বেশি ঘনত্বে মাছ চাষ
চরম ঘনত্বে মাছ চাষ
বায়োফ্লক ব্যবস্থার সুবিধা

পরিবেশবান্ধব মৎস্য চাষ ব্যবস্থা
ভূমি ও পানির কাযকর ব্যবহার নিশ্চিত করে অপচয় রোধ করে
সীমিত বা একেবারেই পানি পরিবর্তনের দরকার হয় না
উচ্চ ফলনশীল পদ্ধতি (মাছ মরে কম, দ্রুত বাড়ে, অতিরিক্ত খাদ্য রূপান্তরিত হয়ে পুষ্টিকর ফ্লকে পরিণত হয়)
বায়ো সিকিউরিটি বা জৈব নিরাপত্তা অতি উচ্চ। অর্থাৎ এ পদ্ধতিতে মাছের রোগবালাই কম হয়
পানি দূষণ কম হয় এবং খামার থেকে রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু বা রাসায়নিক পরিবেশে ছড়ায় না
খাবার খরচ কম হয়
বাজারের দামি প্রোটিন সমৃদ্ধ খাদ্য বা সাধারণ খাদ্য ব্যবহারের দরকার হয় না

বায়োফ্লক পদ্ধতির অসুবিধা
সব সময় পানি উলটপালট ও সার্বক্ষণিক এয়ারেশনের কারণে প্রচুর বিদ্যুৎ খরচ হয়
পানিতে অক্সিজেন সরবরাহ ও শ্বসন প্রক্রিয়া বেড়ে যাওয়ার কারণে দ্রুতই ফ্লক বা খাবার শেষ হয়ে যায়
এ ব্যবস্থার মধ্যে মাছ ছাড়ার জন্য ফ্লক তৈরি হতে নির্দিষ্ট সময় অবধি অপেক্ষা করতে হয়
ক্ষারীয় ভারসাম্য রক্ষায় নিয়মিত সাপ্লিমেন্ট বা সম্পূরক দিতে হয়
নাইট্রেট জমে গিয়ে দূষণ মাত্রা হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে
সূর্যের আলোর ওপর উৎপাদন নির্ভর করে। এ কারণে বর্ষাকালে যখন আকাশ বেশি মেঘলা থাকে তখন উৎপাদন কমে যেতে পারে।

আরো পড়ুন: 

Post a Comment

0 Comments