ধানের খোল পচা রোগ |
ধানের খোল পচা রোগ (Sheath rot)। এ রোগের কারণ স্যারোক্লেডিয়াম ওরাইজি (Sarocladium oryzae) নামক ছত্রাক। এ রোগ হলে শীষ বের হতে দেরি হয় অথবা সময়ের আগেই শীষ বেরিয়ে যায়। ফলে দানা বাঁধে না, কখনো সম্পূর্ণ বন্ধ্যা শীষ বের হয়। খোল পচা রোগের কারণে শীষে পচন ধরে ফলে ধানের দানার কোয়ালিটি খারাপ হয়ে যায় এবং বিবর্ণ হয়। ফলে এ চাল খাওয়াও যায় না, আবার বিক্রিও হয় না।
রোগের বিস্তার
এটা মূলত বীজবাহিত রোগ। এ রোগের জীবাণু রোগাক্রান্ত নাড়া ও বিকল্প পোষকে অবস্থান করে। মাজরা পোকা ও টুংরো রোগ আক্রান্ত গাছে এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি হয়। গরম ও স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়ায় এ রোগ বৃদ্ধি পায়। বৃষ্টির ঝাপটায় এ রোগ ছড়ায়। খোলপচা রোগটি সব মৌসুমেই দেখা যায়। সাধারণত গাছের থোর অবস্থা এ রোগটির উপযোগী সময়।
ক. বৃষ্টির পানির ওপর নির্ভরশীল মৌসুমে খোল পচা রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি হয়। অর্থাৎ আমন ও আউশ মৌসুমে এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
খ. এটি শুষ্ক আবহাওয়ার চেয়ে ভেজা বা আর্দ্র আবহাওয়া যেমন: বর্ষাকালে বেশি হয়।
গ. বেশি ঘন করে ধান রোপণ করলে পোকায় কাটা বা অন্য কারণে গাছের কোনো ক্ষত বা আঘাতের মাধ্যমে এ রোগ দ্রুত ছড়ায়। শীষ বের হওয়ার ঠিক আগে আগে মাজরা পোকার কারণে ধান গাছে ক্ষত তৈরি হলে আক্রান্ত জমিতে খোল পচা রোগের ছত্রাক দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
ঘ. থোড় আসার সময় পাতার যে খোল শীষটিকে ঢেকে রাখে এ ছত্রাক প্রথমে ওই খোলটিতে আক্রমণ করে ফলে সেটির অগ্রভাগ পচে যায়। তখন শীষ বের হওয়া বিলম্বিত হয় অথবা সময়ের আগেই বের হয়ে যায়। ফলে দানা হয় না।
ঙ. জমিতে অতিরিক্ত নাইট্রোজেন সার (ইউরিয়া) প্রয়োগ করলেও এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।
চ. বাতাসে উচ্চ আপেক্ষিত আর্দ্রতা এবং ধান গাছ যখন প্রাপ্তবয়স্ক তখন তাপমাত্রা ২০-১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকলে খোল পচা রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
রোগের লক্ষণ
রোগটি কোনো অবস্থাতেই পাতায় হয় না। খোলপচা রোগটি যে কোনো খোলে হতে পারে তবে শুধুমাত্র ডিগ পাতার খোল আক্রান্ত হলেই ক্ষতি হয়ে থাকে। ধানে থোড় আসার সময় এ রোগের আক্রমণ দেখা যায়।
প্রথমে ধান গাছের শেষ পাতার (সবচেয়ে উপরের পাতা) খোলের ওপর গোলাকার বা অনিয়মিত লম্বা দাগ হয়। দাগের কেন্দ্র ধূসর ও কিনারা বাদামি রঙ বা ধূসর বাদামি হয়।
খোলের উপর ঘন লালচে, বাদামি কিনার এবং মধ্যখানে ধূসর অথবা পুরোটা ধূসর বাদামি রঙের অনিয়মিত দাগ দেখা যায়।
দাগগুলো একত্রে বড় হয়ে সম্পূর্ণ খোলেই ছড়াতে পারে।
থোড়ের মুখ বা শীষ পচে যায় এবং সাদাটে গুঁড়া ছত্রাক খোলের উপর প্রচুর দেখা যায়।
কিছু বের হয়েছে এমন শীষ পচে যায়।
রোগের আক্রমণ বেশি হলে অনেক সময় শীষ আংশিক বের হয় বা মোটেই বের হতে পারে না এবং ধান কালো ও চিটা হয়ে যায়।
ধানের খোল পচা রোগের লক্ষণ |
খোল পচা রোগের সঙ্গে অনেকে খোল পোড়া রোগ গুলিয়ে ফেলতে পারেন। খোল পোড়া রোগের লক্ষণ দেখা যায় পাতায় এবং এ রোগ শীষ বের হওয়াতে কোনো সমস্যা তৈরি করে না। খোল পচা রোগের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে নিচের লক্ষণগুলো খেয়াল করুন:
ক. পাতার যে খোলটি থোড় পেঁচিয়ে ঢেকে রাখে সেটির ঠিক উপরের মাথায় ক্ষত বা দাগ দেখা যাবে।
খ. আংশিক বের হওয়া শীষ বা গর্ভে থাকা শীষ আক্রান্ত হয়।
গ. খোল পচে যায়।
ঘ. আক্রান্ত খোলে সাদাটে পাউডারের মতো ছত্রাক জমা হয়।
ঙ. বন্ধ্যা শীষ। এ শীষে দানা হয় না।
গুরুত্ব
খোল পচা রোগ ধানের বাড়ন্ত সময়ে হয়। তবে শীষ আসার সময় আক্রমণ করলে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। তাইওয়ানে এ রোগের কারণে প্রতি বছর ২০-৮৫%, ভিয়েতনাম ও ভারতে ৩০-৮০% ধান নষ্ট হয়। জাপানে প্রতি বছর ৫১০০০-১২২০০০ হেক্টর জমি এ রোগের আক্রান্ত হয় এবং এতে ফসলের ক্ষতি হয় ১৬০০০-৩৫০০০ টন।
আক্রান্ত ধান বীজই এ রোগের প্রধান বাহক ও পোষক।
রোগের প্রতিকার
সুস্থ বীজ ব্যবহার করতে হবে।
কার্বেন্ডাজিম (অটোস্টিন) অথবা কার্বোক্সিন + থিরাম (প্রোভ্যাক্স ২০০ ডব্লিউপি) প্রতি কেজি বীজে ২.৫ গ্রাম হারে মিশিয়ে শোধন করে বীজতলায় বুনতে হবে।
আক্রান্ত জমির উচ্ছিষ্ট যেমন, খড়, নাড়া, ঘাস ইত্যাদিতে রোগের জীবাণু থাকতে পারে। এ কারণে ফসল সংগ্রহের পর জমি পরিষ্কার করতে হবে।
বেশি ঘন করে ধান রোপণ করবেন না।
সুষম সার ব্যবহার ও ইউরিয়া সার কম প্রয়োগ করতে হবে। চাষের সময় পটাশ সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে।
ক্ষেতে ক্যালসিয়াম সালফেট ও জিঙ্ক সালফেট স্প্রে করুন।
খোল পচা দেখা দিলে জমির পানি শুকিয়ে কিছুদিন পর আবার সেচের পানি দিতে হবে। ছত্রাকনাশক প্রোপিকোনাজোল (টিল্ট ২৫০ ইসি) ১ লিটার পানিতে ১ মিলি হারে মিশিয়ে ১০ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে। এছাড়া ছত্রাকনাশক হিসেবে বেনোমাইল এবং কপার অক্সিক্লোরাইড স্প্রে করা যেতে পারে।
0 Comments