বায়োফ্লক সিস্টেম তৈরির প্রথম ধাপ হচ্ছে ট্যাংক তৈরি। ট্যাংক তৈরিতে সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হয় সেটি হলো ওয়াটারপ্রুফ হওয়া। অর্থাৎ ট্যাংক যেন কোনোভাবে পানি চুইয়ে না পড়ে। এর জন্য ট্যাংকটি কংক্রিট (সিমেন্ট, বালু, রড) অথবা লোহার ফ্রেমে এইচডিপিই জিওমেমব্রেন দিয়েও বানাতে পারেন। চাইলে মাটি খুঁড়ে পুকুর করে তার ওপর এইচডিপিই জিওমেমব্রেন (HDPE geomembrane) বিছিয়েও বায়োফ্লক পন্ড বা পুকুর বানাতে পারেন।
তবে ছোট প্রজেক্টের জন্য সবচেয়ে ভালো হয় মাটির উপর লোহার রডের ফ্রেম করে এইচডিপিই জিওমেমব্রেন জড়িয়ে ট্যাংক তৈরি করা। অবশ্য কংক্রিটের ট্যাংকও বানাতে পারেন। সেক্ষেত্রে কিন্তু ইট গেঁথে ট্যাংক বানানো ঠিক হবে না। তাতে লিক প্রুফ করতে পারাটা কঠিন। সবচেয়ে ভালো হয় ঢালাই দিয়ে তৈরি করা।
এবার আসা যাক ট্যাংকের আকার আকৃতির প্রসঙ্গে। ট্যাংকটি কোন আকৃতির বানাবেন সেটি অনেকটাই আপনার পছন্দের ওপর নির্ভর করে। আপনি কংক্রিটের ট্যাংক বানাতে চাইলে সেটি বর্গাকার, আয়তাকার বা বৃত্তাকার যে কোনোটি হতে পারে। তবে সবচেয়ে উত্তম হলো বৃত্তাকার (Cylinder) ট্যাংক বানানো।
ট্যাংক খোলা স্থানে রোদ পড়ে এমন স্থানে স্থাপন করলে উপরে অবশ্যই স্বচ্ছ ত্রিপোল বা পলিথিন বা প্লাস্টিকের টিনের ছাদ বা সামিয়ানা যাই বলি না কেন তা টানাতে হবে। সরাসরি রোদ পড়তে দিয়ে পানি অতিরিক্ত গরম হয়ে উঠতে পারে। বিশেষ করে গরমের সময় এটি অত্যন্ত বিপজ্জনক।
বর্গাকার বা আয়তাকার ট্যাংকের সমস্যা হলো এর কোণাগুলা ডেড জোনে পরিণত হতে পারে। এরেটর সার্বক্ষণিক চালিয়ে রাখলেও পানির স্রোত ওই কোণাগুলোতে পৌঁছায় না। এতে সেখানে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয়, অতিরিক্ত ফ্লক ও জৈব বস্তু জমে গিয়ে বিষাক্ত গ্যাস তৈরি করতে পারে। তাতে ক্রমেই পুরো সিস্টেমের পরিবেশ বিষাক্ত হয়ে উঠতে পারে। এ কারণে পুকুর তৈরির ক্ষেত্রেও খেয়াল রাখতে হবে যেন চোখা কোণা না থাকে। অর্থাৎ চার কোণা পুকুর তৈরি করলেও কোণাগুলো যেন হয় রাউন্ড।
চার কোণার চাইতে বৃহত্তাকার (Cylinder) ট্যাংক বা পুকুরের কিছু বাড়তি সুবিধা আছে। এ ধরনের ট্যাংক বা পুকুরকে সহজেই লিক প্রুফ করা যায়। এছাড়া এর ব্যাসার্ধ বরাবর এরেটর বসালে যে স্রোত তৈরি হবে তা পুরো ট্যাংক বা পুকুরে একটি বৃত্তাকার স্রোত তৈরি করবে। বিশেষ করে বড় সিস্টেমের জন্য এটি অত্যন্ত দরকারি।
রডের ফ্রেম দিয়ে ট্যাংক বানানো সবচেয়ে সহজ। চাইলে নিজেই বৃত্তকারে দাগ কেটে নিয়ে রড ঝালাই করে ফ্রেম বানিয়ে নিতে পারেন। এর আগে অবশ্যই মেঝেতে কংক্রিট বিছিয়ে প্লাস্টার করে নিতে হবে। বায়োফ্লক ট্যাংক বানানোর প্রচুর ভিডিও এখন ইউটিউবে পাওয়া যায়। আগে কিছু ভিডিও দেখে ধারণা নেওয়া যেতে পারে।
দেশে অসমোসিয়া অ্যাকুয়াকালচার অ্যান্ড ওয়াটার টেকনোলজি (OSMOSIA Aquaculture & Water Technology) নামে একটি বায়োফ্লক ট্যাংকের যাবতীয় সরঞ্জাম বাজারজাত করে থাকে।
ট্যাংকের ধারণাক্ষমতার হিসাব
কী পরিমান মাছ চাষ করতে চাই সেটির ওপর নির্ভর করে ট্যাংক বানাতে হবে। প্রতিটি গড়ে ৩৫ গ্রাম ওজনের থাই নীল তেলাপিয়ার পোনা ৮৪ দিন পালনের জন্য প্রতি ঘনমিটারে (m^3) ২০, ৪০ এবং ৬০টি রাখা যেতে পারে। এটি জিরো-এক্সচেঞ্জ বায়োফ্লক ওয়াটার সিস্টেমের জন্য প্রযোজ্য। অর্থাৎ একবারও পানি পরিবর্তন না করলে এর বেশি মাছ রাখা উচিত নয়। তবে ৮৪ দিনের পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য চারটি ট্যাংক লাগতে পারে। অর্থাৎ প্রথম ধাপের পর মাছগুলো আরেকটি ট্যাংকে স্থানান্তর করতে হবে। আর ৫০ গ্রামের ওপর ওজনের পোনা নিয়ে শুরু করতে চাইলে একটি ট্যাংকেই যথেষ্ট।
তবে লাল তেলাপিয়া চাষ করতে চাইলে ঘনত্ব কমাতে হবে।
এবার হিসাব-নিকাশ করা যাক:
ট্যাংক যদি চার কোণা হয় তাহলে আকৃতির অনুযায়ী আয়তনের সূত্র বের করতে হবে।
যেমন:
বর্গাকার হলে অর্থাৎ ট্যাংকের চারদিক যদি সমান হয় তাহলে আয়তনের সূত্র হবে:
আয়তন (V) = যে কোনো এক বাহুর বর্গ (a^2) x উচ্চতা (h)
বর্গাকৃতির ট্যাংকের আয়তন পরিমাপ |
আবার ট্যাংকের আকার আয়তাকার হলে আয়তনের সূত্র:
আয়তন (V) = দৈর্ঘ্য (l) x প্রস্থ্য (w) x উচ্চতা (h)
আয়তাকার ট্যাংকের আয়তন পরিমাপ |
বৃত্তাকার বা সিলিন্ডার আকৃতির হলে আয়তনের সূত্র:
আয়তন (V) = π x ব্যাসার্ধের বর্গ (r^2) x উচ্চতা (h)
সিলিন্ডার বা কুয়ার আকৃতির ট্যাংকের আয়তন পরিমাপ |
এখানে উচ্চতা হলো ট্যাংকের তলা থেকে উপরের কানা পর্যন্ত । যেহেতু ট্যাংক ভরপুর করে পানি ভরা ঠিক হবে না অন্তত এক ফুট খালি রাখতে হবে সেহেতু পানি যতোখানি ভরতে চাই ততোদূর পর্যন্ত উচ্চতা হিসাব করতে হবে।
আরো কিছু হিসাব জেনে রাখা ভালো। এখানে দৈর্ঘ্য (l), প্রস্থ্য (d), উচ্চতা (h) ও ব্যাসার্ধ (r) -এর ধরা হয়েছে মিটার। সুতরাং আয়তনের (ভলিউম) পরিমান আসবে কিউবিক মিটার বা ঘনমিটারে। এটিকে লিটারে পরিবর্তন করে নিতে হবে। হিসাবের সুবিধার জন্য ঘন সেন্টিমিটার, ঘনমিটার ও ঘনফুটের সঙ্গে লিটারের তুলনা নিচে দেওয়া হলো:
১ ঘনমিটার = ১০০০ লিটার
১ ঘনফুট = ২৮.৩২ লিটার
১ ঘিন সেন্টিমিটার = ০.০০১ লিটার
আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা দরকার সেটি হলো, ট্যাংক যদি ছোট আকৃতির হয় তাহলে এরেটর হিসেবে মোটরচালিত এয়ার স্টোন বাবল পাম্প ব্যবহার করা উচিত। আর বড় প্রজেক্ট হলে মটরচালিত অক্সিজেন প্যাডল এরেটর ব্যবহার করতে হবে। এয়ার স্টোন বাবল পাম্প অ্যাকুরিয়ামেও ব্যবহার করা হয়। সুতরাং দেশেই অ্যাকুরিয়ামের দোকানে পাওয়া যেতে পারে।
ট্যাংকের তলদেশে ভালভযুক্ত আউটলেট পাইপ রাখতে হবে। কারণ কোনো কারণে স্লাজ বেড়ে গেলে ফ্লকের ঘনত্ব অত্যধিক বেড়ে যেতে পারে। তখন অতিরিক্ত স্লাজ বের করে দেওয়ার প্রয়োজন পড়তে পারে। তাছাড়া একটা প্রজেক্ট শেষ হওয়ার পর সম্পূর্ণ পানি বের করে দিয়ে ট্যাংক ভালেোভাবে পরিষ্কার করতে হবে। জীবাণুমুক্ত করে শুকিয়ে নিয়ে তারপর নতুন প্রজেক্ট শুরু করতে হবে।
বায়োফ্লক পুকুর হলে একাধিক বাবল পাম্প এবং আউটলেট পাইপ বসাতে হতে পারে। খেয়াল রাখতে হবে সিস্টেমে পর্যাপ্ত অক্সিজেনের সরবরাহ না থাকলে প্রয়োজনীয় ফ্লক তৈরি হবে না। মাছও আরামবোধ না করার কারণে খাবার গ্রহণ কমিয়ে দেবে।
আরো পড়ুন:
0 Comments