মিষ্টিমরিচ (ক্যাপসিকাম) পৃথিবীর অনেক দেশেই একটি জনপ্রিয় সবজি। বাংলাদেশেও ইদানীং এটি ক্রমেই জনপ্রিয় হচ্ছে এবং দামও অন্য সবজির চেয়ে সব সময় বেশিই থাকে। ক্যাপসিকামের ব্যবহার বহুবিধ- এটি সালাদ, সবজি, রোস্ট নানাভাবেই খাওয়া যায়।
তাছাড়া ক্যাপসিকামের অনেক ঔষধি গুন আছে। পুষ্টিমানের দিক থেকে ক্যাপসিকাম একটি অত্যন্ত দামি সবজি। প্রতি ১০০ গ্রামে ১১ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ৮৭০ আইইউ ভিটামিন ‘এ’ এবং ১৭৫ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি আছে।
ক্যাপসিকাম চাষ করাও কিন্তু বেশ সহজ। আজকাল বিশেষ করে শহরে এই মরিচের খাওয়ার চল দেখা যাচ্ছে। ফলে বারান্দায় বা ছাদে সবজি বাগান করছেন তাদের অন্তত একটি পবে ক্যাপসিকামের চারা থাকে। মাঝারি সাইজের একটা হলেই চার সদস্যের একটি পরিবারের একবেলার খাওয়া হয়ে যায়।
আজকাল চাইনিজ ডিশ দারুণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। লাঞ্চ বক্সে যেই চাইনিজ সবজিটা থাকে সেখানে কিন্তু ক্যাপসিকাম মাস্ট। এছাড়া ফ্রায়েড রাইসেও অবশ্যই ক্যাপসিকাম থাকে। ফলে হোটেল রেস্টুরেন্টে এই সবজির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এটি কিন্তু চাষী ভাইদের জন্য একটি সুখবর। যারা শহরে কৃষিকাজ করতে ভালোবাসেন তাদের জন্যও এটি বড় সুযোগ হতে পারে। চাইলে ছাদে বাণিজ্যিকভাবে ক্যাটসিকাম চাষ করতে পারেন। বিক্রি নিয়ে আপনাকে খুব একটা বেগ পেতে হবে না। দামও পাবেন ভালো।
ক্যাপসিকাম হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতেও সহজেই চাষ করা যায়। ছোট গাছ কিন্তু বেশি ফল পাওয়া যায়। এ কারণে হাইড্রোপনিক পদ্ধতির জন্য একটি উপযুক্ত ফসল এই ক্যাপসিকাম। আপনি আপনার ছাদে ছোট্ট একটি হাইড্রোপনিক সিস্টেমে ক্যাপসিকাম চাষ করে মাসে ২০-৩০ হাজার টাকা আয় করতে পারেন।
এবার জেনে নেওয়া যাক হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে ক্যাপসিকাম চাষ করবো কীভাবে:
জাত নির্বাচন ও বীজের পরিমাণ
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) বারি মিষ্টিমরিচ-১ ও বারি মিষ্টিমরিচ-২ নামে ক্যাপসিকামের দুটি জাত উদ্ভাবন করেছে। এছাড়াও ক্যালিফোর্নিয়া ওয়ান্ডার জাতটিও দেশে চাষ হচ্ছে। তবে দেশীয় জাত বাছাই করাই ভালো। কারণ এসব জাত দেশের আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খেয়ে নিতে পারে সহজেই। ফলে রোগবালাই কম হবে।
এক গ্রামে গড়ে ১৬০টির মতো ক্যাপসিকাম বীজ থাকে। সে হিসাবে মাটিতে চাষ করতে চাইলে হেক্টরপ্রতি ২৩০ গ্রামের বেশি বীজের প্রয়োজন হয় না। আর হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে চাষ করতে চাইলে তো একটি পিটের (গর্ত) মধ্যে অবশ্যই একটি গাছই লাগাবেন।
চারা উৎপাদন
হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে ক্যাপসিকাম চারা উৎপাদনের জন্য প্রথমে একটি প্লেটে খবরের কাগজ বা টিস্যু পেপার বিছিয়ে তার উপর বীজ ঘন করে ছিটিয়ে দিতে হবে। এর পর বীজের উপর হালকা পানি দিয়ে ভিজিয়ে দিয়ে উপরে আরেকটি খবরের কাগজ বা টিস্যু পেপার দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। একদম শুকিয়ে যেন না যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। প্রয়োজনে মাঝেমধ্যে হালকা পানি ছিটিয়ে দিতে হবে।
বীজ অঙ্কুরিত (গজানো) হওয়া শুরু করলে বীজকে স্পঞ্জ ব্লকের (Sponge block) গর্তে স্থাপন করতে হবে। এরপর Sponge block গুলোকে পানির ট্রেতে ভাসিয়ে রাখতে হবে। যখন চারায় ২-৩টি পাতা আসবে তখন থেকে প্রতিদিন ট্রেতে ২০-৩০ মিলিলিটার খাদ্য উপাদান দ্রবণ A এবং B যোগ করতে হবে। EC এর মান ০.৫-০.৮ ds/m এর মধ্যে রাখতে হবে। চারার বয়স ২০-২৫ দিন হলে চারাগুলো কর্কসিটের মাঝে ছিদ্র করে রোপণ করতে হবে।
চারা রোপণ পদ্ধতি
ট্রের আকার অনুযায়ী পরিমাণে মতো পানি ভরতে হবে। পানির গভীরতা ৬-৮ সেমি হতে হবে। প্রতি ১০০ লিটার পানির জন্য ১ লিটার ক্যাপসিকাম নিউট্রিয়েন্ট সলিউশন A ও B যোগ করতে হবে। দ্রবণ যোগ করার সময় প্রথমে নিউট্রিয়ন্ট A যোগ করে পানিতে ভালোভাবে মিশিয়ে নিতে হবে এবং পরে খাদ্য নিউট্রিয়েন্ট সলিউশান B যোগ করে ভালোভাবে মিশাতে হবে।
দ্রবণের মিশ্রণ তৈরির পর ট্রের উপর কর্কসিট স্থাপন করতে হবে। প্রতিটি গাছ থেকে গাছ এবং সারি থেকে সারির মধ্যে ৩০ সেমি দূরত্ব রাখতে হবে। কর্কসিটের উপর এই দূরত্ব অনুযায়ী ছোট ছিদ্র করতে হবে। তারপর প্রতিটি ছিদ্রে ১টি করে চারা রোপণ করতে হবে।
সাধারণত ২০-২৫ দিন পর পর ট্রেতে ১০% খাদ্য উপাদান সম্বলিত জলীয় দ্রবণ যোগ করতে হয়।
প্লাস্টিকের বালতিতে ক্যাপসিকাম চাষ
যদি খুবই ছোট আকারের হাইড্রোপনিক সিস্টেমের মধ্যে ক্যাপসিকাম চাষ করতে চান তাহলে প্লাস্টিকের বালতি বেছে নিতে পারেন। এতে পাইপ, মটর এসব ঝামেরায় যেতে হবে না। এটি অত্যন্ত সহজ পদ্ধতি। আগের মতোই চারা তৈরি করে নিতে হবে। আর চারা রোপণ করবেন নিচের বর্ণনা অনুযায়ী:
বালতির উপর গোল করে কাটা কর্কশিট স্থাপন করতে হবে। মাঝের ছোট গর্তে ১টি করে চারা লাগাতে হবে। চারা রোপণের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যেন দ্রবণ ও গাছের গোড়ার মাঝে ২.৫৪ সেমি বা ১ ইঞ্চি জায়গা ফাঁকা থাকে এবং শিকড় দ্রবণ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে।
সাধারণত শিকড়ের এক-তৃতীয়াংশ (তিন ভাগের এক ভাগ) পানিতে এবং দুই-তৃতীয়াংশ (তিন ভাগের দুই ভাগ) বালতির ফাঁকা জায়গা রাখতে হবে। এবার বালতিটিকে আলো ও বাতাস চলাচল করে এমন স্থানে রাখতে হবে।
ব্যবস্থাপনা
গাছের বৃদ্ধির সাথে সাথে তার খাদ্য উপাদানের চাহিদা বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। সাধারণত ১৫-২০ দিন পর অল্প পরিমাণ খাদ্য উপাদান মিশ্রিত দ্রবণ দ্রবণ যোগ করতে হয়। গাছের বৃদ্ধির সময় উপরের পাতা হলুদ হয়ে গেলে ৫ গ্রাম ইডিটিএ আয়রন ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রতি ১০০ লিটার পানির জন্য ২০০ মিলি হারে প্রয়োগ করতে হবে।
গাছে ফুল আসা শুরু হলে গাছের খাবার দ্রবণের মাত্রা বাড়াতে হবে এবং এই সময় দ্রবণের EC ২.০ থেকে ২.৫ এবং পিএইচ ৬.০-৬.৫ এর মধ্যে রাখতে হবে। গাছের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধির সাথে সাথে তাকে সোজা করে দাঁড়িয়ে রাখতে গাছের গোড়ায় একটি রশি বাঁধতে হবে।
রোগবালাই, পোকামাকড়ের আক্রমণ ও প্রতিকার
হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদে ফসলে রোগবালাই খুব কম হয়। পোকামাকড়ও তেমন হয় না। আর গ্রিনহাউস পদ্ধতি বা স্বচ্ছ পলিথিনে ঘেরা পদ্ধতিতে যদি চাষ করা হয় তাহলে রোগ ও পোকামাকড় থেকে প্রায় শতভাগ নিরাপদ থাকা যায়।
তারপরও মাঝে মাঝে লাল মাকড়সা, সাদা মাছি, থ্রিপস, লিফ মাইনার বা জাব পোকার আক্রমণ হতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রতি ১ লিটার ভার্টিমেক (লাল মাকড়সার জন্য), ১ মিলি লিটার এডমায়ার (লিফ মাইনরি, থ্রিপস এবং জাব পোকার জন্য) এবং সবিক্রন ২ মিলি লিটার (সাদা মাছির জন্য) ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৭ দিন পর পর স্প্রে করলে এসব পোকামাকড় দমন করা যায়। এছাড়া ফসলের আশে পাশে হলুদ ও সাদা রঙের আঁঠাযুক্ত ফাঁদ পেতে রাখলে তাতে জাবপোকা ও থ্রিপস জাতীয় পোকা সহজেই দমন করা যায়।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) একটি প্লটে হাড্রোপনিক পদ্ধতিতে ক্যাপসিকাম চাষ |
ফসল সংগ্রহ
সাধারণত চারা রোপণের ২৫-৩০ দিনের মধ্যে ফুল আসতে শুরু করে। আর চারা রোপণের ৫৫-৬০ দিনের মধ্যে ক্যাপসিকাম সংগ্রহ করা যায়। ফলের ঠিক নিচে ফুল ঝরে পড়ার পর ফল সংগ্রহ করতে হবে। সপ্তাহে একবার ফল সংগ্রহ করাই ভালো। বোঁটাসহ ফল সংগ্রহ করে ছায়াযুক্ত ঠাণ্ডা জায়গায় সংরক্ষণ করে বাজারজাত করুন। তাতে অনেকক্ষণ ফল টাটকা থাকবে।
প্রতিটি সুস্থ গাছে ৮-১০ টি করে ফল ধরে। প্রতিটি গাছ থেকে ৮০০-১২০০ গ্রাম পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়। সাধারণত মাটিতে ক্যাপসিকাম চাষ করলে ফল সংগ্রহ করতে যতদিন সময় লাগে হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে তার চেয়ে ১২-১৫ দিন আগেই ফল সংগ্রহ করা যায়।
ফলন
সঠিক পদ্ধতিতে ক্যাপসিকাম চাষ করতে পারলে জমিতে যেখানে হেক্টর প্রতি ২০-২৫ টন ফলন পাওয়া সেখানে একই পরিমাণ জায়গা থেকে হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে ৬০-৭০ টন পর্যন্ত ফলন পাওয়া সম্ভব।
হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে ক্যাপসিকাম চাষের একটা হিসাব এখানে তুলে ধরা হলো। আপনি যদি বাণিজ্যিকভাবে হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে ক্যাপসিকাম চাষ করতে চান তাহলে এই হিসাব কিছু ধারণা দেবে।
প্রতি ৩ মিটার x ১ মিটার মাপের ট্রেতে ৩০ সেমি. x ২০ সেমি গাছের দূরত্বে মোট ৩৬টি গাছ লাগানো যায়। যেখানে মাঠের গাছের সংখ্যার ৩ গুন।
এক মৌসুমে প্রতিটি ট্রেতে রাসায়নিক দ্রবণ বাবদ খরচ ৮০০ টাকা
কর্কশিট বাবদ খরচ ৩০০ টাকা
অন্যান্য বাবদ খরচ ৬০০ টাকা
মোট খরচ ১ হাজার ৭০০ টাকা।
ভারতের আন্দামান দ্বীপে হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে ক্যাপসিকাম চাষ করছেন বাংলাদেশিরা |
আয়
প্রতি গাছ থেকে ফলন = ১.০ কেজি (গড়ে); সুতরাং ৩৬টি গাছ থেকে ফলন = ৩৬ কেজি।
প্রতি কেজি ক্যাপসিকামের বাজারমূল্য ১০০ টাকা হিসাবে ৩৬ কেজির দাম = ৩ হাজার ৬০০ টাকা। অর্থাৎ প্রতি ৩ বর্গমিটার ট্রেতে লাভ = ৩,৬০০ - ১,৭০০ = ১,৯০০ টাকা।
আরো পড়ুন:
0 Comments