সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

খড়ে কি পুষ্টি আছে? গরুকে খড় খাওয়ানো যাবে কি?

rice straw for cattle feed

আমাদের দেশে গরু পালন করতে গেলে খড় ছাড়া গতি নাই।  আগে বিশেষ করে শীতকালে গৃহস্থ্যবাড়িতে গরুর প্রধান খাদ্য হয়ে উঠতো পালা করে রাখা খড়। গরু সারাদিন এই খড় চিবাতো আর তিন বেলা একটু ভাত, খুদ, লবণ, আটা, সম্ভব হলে দুফোঁটা চিটগুড় দিয়ে গুলে পানি খাওয়ানো হতো। এই ছিল আমাদের দেশের গরুর নিয়মিত রেশন। সম্ভব খাবারের এই মানের কারণেই দেশীয় গরুর জাত উন্নয়ন সেভাবে হয়নি।

তাহলে বাণিজ্যিক খামারে গরুকে খড় খাওয়াবো না? এতে কি কোনোই লাভ নেই? গরু খড় কোনো পুষ্টি পায় না? যদি তাই হয়, এবং খামারিরা খড় খাওয়ানো বন্ধ করতে চায় তাহলে তার খামারের খাবারের পেছনে খরচ কিন্তু অন্তত ১০ শতাংশ বেড়ে যাবে।

আরেকটু বিস্তারিত
গরুর খাদ্য হিসাবে খড় (রাইস স্ট্র) বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় গোখাদ্য। এশিয়ার প্রায় সব উষ্ণ দেশে গরুর অন্যতম প্রধান খাবার খড়। গরুর রুমেনের স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য ইউরোপ আমেরিকাসহ অনেক দেশ খড় আমদানি করে। কম পুষ্টিগুণ, অধিক মাত্রায় সিলিকা ও সালফার, এই ধরনের বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও খড় ছাড়া গরু পালন একেবারেই অসম্ভব। অবশ্য যদি বিকল্প কোনো খড় জাতীয় বস্তু যেমন ‘হে’ (শুকনো ঘাস বা লতাপাতা) থাকলে আলাদা কথা।

পুষ্টিমান কম হলেও খড়ে আঁশের পরিমান বেশি থাকায় গরুর পেট ভরাতে এবং রুমেনের স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে বেশ কার্যকরী খাবার হচ্ছে খড়। খড়ের সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও প্রায় দেশেই গরুকেই খড় খাওয়ানো হয়। ইতালি, ফ্রান্স, ইংল্যান্ডেও গরুকে খড় খাওয়ানো হয়। 

খড় খাওয়াবো কি খাওয়াবো না সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে দেখা যাক আসলে খড়ের মধ্যে কী কী উপাদান রয়েছে:

খড়ের প্রোটিন কমপক্ষে ড্রাই ম্যাটারের ৪% এবং গড়ে ৫%। খড়ে প্রোটিন কম হলেও ড্রাই ম্যাটার প্রায় ৮৮-৯০%। ড্রাই ম্যাটার বেশি হওয়ায় এক কেজি খড় থেকে কম পক্ষে ৫ কেজি পুষ্টিকর ঘাসের সমান পুষ্টি গরু পেয়ে থাকে। সব খাবারেই এনডিএফ থাকে। কম এনডিএফ গরুর রুমেনের জন্য ক্ষতিকর। কম মাত্রায় এনডিএফ থাকা জরুরি। লিগনিন সব খাবারে থাকে। লিগনিন হজম হয় না। লিগনিন পেট ভরতে সাহায্য করে ফলে গরু ক্ষুধা অনুভব করে না। পুষ্টির সাথে সাথে ক্ষুধাজনিত অবসাদ দূর করাও জরুরি। 

এছাড়া লিগনিন রুমেনের পিএইচ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে এবং হজম প্রক্রিয়া সহজ করে, কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে।

১. ধানের খড়ে সুপাচ্য প্রোটিন আছে ৩%। হজমযোগ্য প্রোটিন আছে  ০.৩-০.৫% বা ০%। 
২. খড়ে NDF বা Neutral detergent fiber বেশি যা রুমেন হজম করতে পারে না।
৩. খড়ে ফাইবার আছে ৬০% যা মূলত লিগনিন, আর লিগনিনকে রুমেন হজম করতে পারে না। ফলে মাইক্রোবিয়াল ফার্মেন্টেশন বাধাগ্রস্ত হয়।
৪. খড়ে সিলিকার পরিমাণ বেশি যা ইন্টেস্টাইন (ক্ষুদ্রান্ত) হজম করতে পারে না। 
৫. খড়ে ফসফরাসের পরিমাণ কম কিন্তু পটাসিয়ামের পরিমাণ বেশি, যা ক্যলাসিয়ামের শোষণে বাধা সৃষ্টি করে।
৬. খড়ে অধিক পরিমাণে অক্সালেট থাকে যা ক্যালসিয়ামের শোষণে বাধা সৃষ্টি করে। 
৭. খড় চিবাতে গিয়ে গরু প্রচুর পরিমাণে শক্তি হারায় যার কারণে প্রতিদিন ২০০-২৫০ গ্রাম ওজন হারায়।
৮. খড়ের টোটাল হজমযোগ্যতা বা ডাইজেস্টিবিলিটি ৪৫-৫০%।
৯. শুধু খড় খাওয়ালে, অতিরিক্ত মিনারেল সরবরাহ করতে হবে। 

ধানের খড়ের গড় পুষ্টি উপাদান (%/ড্রাই ম্যাটার) 
ড্রাই ম্যাটার                   :  ৯২.৮ "
ক্রুড প্রোটিন                  :  ৪.২ "
ক্রুড ফাইবার                 :  ৩৫.১ "
ক্রুড ফ্যাট                      :  ১.৪ "
নিউট্রাল ডিটারজেন্ট ফাইবার : ৬৯.১ "
এসিড ডিটারজেন্ট ফাইবার  : ৪২.৪ "
লিগনিন                 : ৪.৮  "
অ্যাশ (ছাই)            :    ১৮.১  "
গ্রস এনার্জি            : ১৫.১মেজুল/কেজি
হজম যোগ্য এনার্জি : ৭.২  " 
বিপাকযোগ্য এনার্জি :  ৫.৮  "

মিনারেলস (খনিজ উপাদান) : (ড্রাই ম্যাটার) 
ক্যালসিয়াম        : ২.৯ গ্রাম/কেজি 
ফসফরাস           : ০.৯   "
পটাসিয়াম           : ১৮.০ "
সোডিয়াম             :  ২.৭ "
ম্যাগনেসিয়াম       :  ১.৯ "
ম্যাঙ্গানিজ             : ৪৫৪ মিগ্রা/কে
জিংক                   : ৩৪  "
কপার                    :  ০৬  "
আয়রন                  : ৩৩৫  " 

ক্ষতিকর উপাদান : ড্রাই ম্যাটারের ১-২% অক্সালেট, ট্যানিন ০.১ গ্রাম/কেজি, সিলিকা, সালফার। 

খড়ের উপকার
মধ্যম মানের ১ কেজি খড় থেকে গড়ে ৬ মেগাজুল বিপাকীয় শক্তি গরু পেয়ে থাকে। খড়ে গরুর শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় প্রধান মিনারেলের পরিমান কম হলেও ট্রেস মিনারেল ঘাসের মতো স্বাভাবিক পরিমানেই আছে। যেহেতু খড়ে আঁশ জাতীয় খাবারের পরিমান বেশি এবং দ্রুত গরুর পেট ভরে তাই খড় বেশি খাওয়ালে গরু অন্য খাদ্য গ্রহণ কমিয়ে দেয়। খড় গরুর রুমেনের পিএইচ বা অম্লতা ঠিক রাখতে সাহায্য করলেও খাবার দ্রুত হজম হতে বাধার সৃষ্টি করে। খড়ের সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে ড্রাই ম্যাটারের পরিমান অন্য খাবারের চেয়ে বেশি, যা প্রায় ৯৩%। যার ফলে গরু দীর্ঘ সময় জাবর কাটে। আর যে গরু যতো বেশি জাবর কাটে তার স্বাস্থ্য ততো বেশি ভালো থাকে। কারণ জাবর কাটা হজম ও খাদ্য উপাদান শোষণে সহায়তা করে।

খড়ের হজমযোগ্যতা বাড়ানোর উপায়

১. টুকরো টুকরো ( ১ ইঞ্চি ) করে কেটে খাওয়ালে হজমযোগ্যতা কিছুটা বাড়ে। 
২. ইউরিয়ার সাথে প্রসেস করলে হজমযোগ্যতা ১৮% বাড়ে। ইউরিয়া মোলাসেস বা ইউএমএস বানিয়ে খাওয়ানো যায়।
৩. খড়কে টুকরো টুকরো করে কেটে ২-৪ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখলে খড়ের অক্সালেট ও পটাসিয়াম পানিতে দ্রবিভূত হয়। ফলে হজমযোগ্যতা বাড়ে।
৪. অন্যান্য ঘাসের সাথে মিক্স করলে হজমযোগ্যতা কিছুটা বাড়ে।

কখন খাওয়ানো যাবে
১. আপদকালীন খাদ্য হিসেবে। ( যদি আপনার ঘাস সাপ্লাই না থাকে বা পাচ্ছেন না )
২. ঘাস আর দানাদার দেওয়ার পরও যদি পেট না ভরে তাহলে দেওয়া যাবে।

মাত্রা ও সাবধানতা
দানাদার খাবার গরুর পুষ্টি সরবরাহ করে ঠিকই কিন্তু পেট ভরাতে পারে না, যার ফলে গরু ক্ষুধাজনিত অবসাদে ভোগে। আর এই সমস্যা সমাধানের সবচেয়ে নিরাপদ ও উপাদেয় খাদ্য হচ্ছে খড়। তাছাড়া দানাদার খাবার গরুর রুমেনের পিএইচ ব্যালান্স নষ্ট করে, এই সমস্যা সমাধানের সহজ উপায় খড় । 

ঘাস গরুর পুষ্টি সরবরাহ করে এবং পেট ও ভরাতে পারে, কিন্তু রুমেনে পানি সরবরাহ বেড়ে যায় যার ফলে গরু নরম বা পাতলা পায়খানা করে। এই সমস্যাগুলোর সমাধানের কাজই খড় করে। একটা গরুকে অন্য খাবারের সাথে সাথে দিনে লাইভ ওয়েটের ২-৩% খড় দিলেই যথেষ্ট। অতিরিক্ত খড় গরুর শরীরে সিলিকার পরিমান বৃদ্ধি করে, যদিও বেশিরভাগ সিলিকা প্রস্রাবের সাথে বের হয়ে যায়। খড়ে থাকা অক্সালেট গরুর শরীরে ক্যালসিয়ামের পরিমান কমিয়ে দেয়, সিলিকা হজমের গতি কমিয়ে দেয় বা বাধাগ্রস্ত করে। তাই গরুকে বিশেষ করে ফ্রিজিয়ান গরুকে মাত্রাতিরিক্ত খড় খাওয়ানো যাবে না। 

বিশেষভাবে ফ্রিজিয়ানের কথা উল্লেখ করার কারণ হচ্ছে, খড়ে থাকা অক্সালেট ক্যালসিয়াম ভেঙে ফেলে। আর ফ্রিজিয়ান গরুতে যেহেতু দুধ বেশি হয়, তাই তার ক্যালসিয়াম চাহিদাও বেশি। অক্সালেটের কারণে ক্যালসিয়াম ঘাটতি হতে পারে। তাছাড়া ফ্রিজিয়ানের হজমশক্তিও কম। 

Post a Comment

0 Comments