গবাদিপশুর বাণিজ্যিক খামারের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো রুটিন মেনে সব কাজ করা। মানুষের ক্ষেত্রে যেমন দীর্ঘ আয়ুর ম্যাজিক হচ্ছে সুশৃঙ্খল জীবন অর্থাৎ সকাল থেকে রাত অবধি একটা বাঁধা রুটিনে জীবনযাপন করা। যেমনি গবাদিপশু থেকে ভালো প্রোডাকশন পেতে চাইলে খাবার, অবসর, যত্ন সবকিছুতে একটা নির্দিষ্ট রুটিন মানাটা জরুরি।
বিশেষ করে দুগ্ধ খামারের জন্য এ কথাটি খুবই সত্য বলে মানতে হবে। একটি খামারের প্রত্যেকটি দুধের গাভী সবদিক থেকে আলাদা। এটি সত্য। কিন্তু গরু খুব সহজেই একটা পরিবেশ ও পরিস্থিতির সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারে। খামারের সব গরু সুস্থ রাখতে ও খামার ব্যবস্থাপনা সহজ করতে রুটিনের মধ্যে সামঞ্জস্য নিশ্চিত করা দরকার।
গবেষণায় দেখা গেছে, সারা দিনে বিভিন্ন কাজে গাভী যেভাবে সময় ব্যয় করে তার একটি সরল তালিকা করলে নিচের মতো হয়:
খাওয়া: ৩-৫ ঘণ্টা (প্রতিদিন ৯-১৪ বার খেতে পারে)
শোয়া বা বিশ্রাম: ১২-১৪ ঘণ্টা
দাঁড়িয়ে থাকা বা হাঁটা: ২-৩ ঘণ্টা
পানি পান: ৩০ মিনিট
বাকি ২.৩-৩.৫ ঘণ্টা খামারের ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম (যেমন: পশুচিকিৎসকের মাধ্যমে নিয়মতি চেক-আপ) বা তাদের প্রতিদিনের দুধ দোহনের রুটিনের জন্য ব্যবহৃত হয়।
ভোর ৫টা বা সূর্যের আলো ফোটার আগে- সকালের দুধ দোহন।
বড় খামারিরা দুধ দোহনের জন্য মেশিন ব্যবহার করেন। মেশিন দিয়ে একটি গরু দুধ দোহন করতে সময় লাগে মাত্র ৫-৭ মিনিট! অনেকের আবার দুধ দোহনের জন্য পার্লার আছে। উন্নত দেশে কেউ কেউ রোবোটিক দুধ দোহন প্রযুক্তি ব্যবহার করেন। শেষের দুই পদ্ধতিই গরু দোহনের জন্য নিরাপদ, দ্রুত এবং গরুর জন্য চাপমুক্ত উপায়।
সকাল ৭টা - খাওয়ানোর সময়
এসময়টাতে পুষ্টিবিদদের সঙ্গে আলোচনা করে আপনার খামারের জন্য উপযুক্ত দানাদার মিশ্রণ ফর্মুলা গ্রহণ করতে পারেন। এক্ষেত্রে বিশেষ রেশন (টিএমআর) যা খড়, দানাশস্য, কর্ন সাইলেজ, প্রোটিন (সয়াবিন জাতীয় খাবার হতে পারে), ভিটামিন এবং খনিজ নির্দিষ্ট অনুপাতে মিশিয়ে তৈরি করা হয়, গরুকে খেতে দেওয়া যেতে পারে।
সকাল ৯টা- শেডের মধ্যে আরাম করার সময়
বাণিজ্যিক খামারের গাভীগুলো সাধারণত পুরো দিন কাটায় উন্মুক্ত শেডের মধ্যে ঘোরাফেরা করে। তারা চাইলে যেখানে সেখানে শুয়ে পড়তেও পারে। এ কারণে চলাফেরা ও শুয়ে আরাম করার জায়গাটি নরম ও শুকনো রাখতে হবে। খড় দিয়ে বিছানা তৈরি বা বালি, রাবার গদি বা এমনকি জলের বিছানা করে দেওয়া যেতে পারে। গরু চলাফেরা করতে গিয়ে যাতে পিছলে না পড়ে সে জন্য শেডের মেঝে প্লাস্টার করা সময় খাঁজ রাখতে হবে। আর গরমের সময় সার্বক্ষণিক ফ্যান চালিয়ে রাখতে হবে। শীতকালেও ঝলমলে রোদ থাকলে বেশি গরম অনুভূতি হতে পারে। তখন ফ্যান চালাতে হবে। ফ্রিজিয়ান গরু কোনোভাবেই গরম সহ্য করতে পারে না। গরমের মধ্যে থাকলে তার হজমে সমস্যা হতে পারে। আর খেয়াল রাখতে হবে খাবারে ট্রে যেন গরুর কাছ থেকে খুব বেশি দূরে না হয়।
দুপুর ১২টা – আবার খাওয়ার সময়
দুগ্ধবতী গাভীর সারাদিনে খাবার এবং পর্যাপ্ত খাওয়ার পানি দিতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে যেন কোনোভাবেই ক্ষুধার্ত না থাকে। একটি দুধের গাভী প্রতিদিন প্রায় ৪৫ কেজি খাবার খায় এবং ১১৩-১৯০ লিটার পানি পান করে।
বেলা ২টা- আবার আরাম করবে
দুগ্ধবতী গাভী যখন খায় না, ঘুমায় বা দুধ দেয় তখন কিন্তু সে জৈবসার তৈরিতে ব্যস্ত থাকে। একটি গাভী দিনে প্রায় ৬৪ লিটার সার (গোবর) উৎপাদন করে – যা ২৫ কেজি ভুট্টা এবং ৩৮ কেজি টমেটো উৎপাদনের জন্য যথেষ্ট প্রাকৃতিক জৈবসার।
বেলা ৩টা: চেক আপের সময়
এই সময়টাতে খামারে ঢুকে প্রতিটি গরু ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। গরুগুলো আরামে আছে কিনা, কোনোটির মধ্যে অস্বস্তি বা অসুস্থতার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে কিনা, কোনটির আলাদা যত্ন দরকার এসব বিষয় গভীরভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে হবে। দরকার পড়লে এসময় মাঝেমধ্যে অভিজ্ঞ পশুচিকিৎসককে সঙ্গে নিয়ে খামার পরিদর্শন করতে হবে।
বিকাল ৫টা- বৈকালিক দুধ দোহন
সাধারণত দিনে ২-৩বার গাভীর দুধ দোহন করতে হয়। দুধগুলো নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর রাখতে দুধ দোহন থেকে শুরু করে সংরক্ষণ ও বহন পর্যন্ত পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। দুধ খামার থেকে ফ্রিজারে নেওয়া অবধি সরাসরি হাতের ছোঁয়া না লাগানোই ভালো। তাকে দুধ জীবাণু দূষণের হাত থেকে রক্ষা পাবে।
রাত ৮টা- শুভরাত্রি
এটি গরুর ঘুমানোর সময়। তীব্র আলো নিভিয়ে মৃদু আলো দিতে হবে। শেষবারের মতো খেয়াল করতে হবে কোনো গরুর কোনো ধরনের অসুবিধা হচ্ছে কিনা, কারো শেয়ার জায়গাটি ভিজা স্যাঁতস্যাঁতে কিনা এসব দেখতে হবে। এসময় যতোটা সম্ভব খামারে নিস্তব্ধতা নামিয়ে আনতে পারলে সবচেয়ে ভালো হয়।
0 Comments