শীতের আগমন বার্তা নিয়ে আসে হেমন্ত। আর হেমন্তের আগমন কার্তিক মাসে। এ মাসেই সকাল বিকাল শিশির পড়তে শুরু করে। রোদের তেজ কমে যায়। শীত শীত অনুভূত হয়। আর এসময় মাঠে আমন ধান কেবল পাকতে শুরু করে। উঠতে শুরু করে শীতের সবজি। এ মাসেই শীতের প্রস্তুতি নিতে শুরু করতে হয়। গবাদিপশু-পাখির ঘর গরম রাখার ব্যবস্থা করা এবং সবুজ ঘাসের সঙ্কট মোকাবেলায় খাবার সংরক্ষণ করতে হয়। ওদিকে পুকুর থেকে মাছ সংগ্রহেরও প্রস্তুতি থাকতে হবে। কারণ মাছ শীতে খাবার গ্রহণ কমিয়ে দেবে। ফলে আর বড় হবে না। পুকুর থেকে তুলে বিক্রির ব্যবস্থা করতে হবে। এই সময়টাতে কৃষকের করণীয়গুলো জেনে নিই।
আমন ধান
এ মাসে অনেকের আমন ধান পেকে যাবে তাই রোদেলা দিন দেখে ধান কাটতে হবে। আগামী মৌসুমের জন্য বীজ রাখতে চাইলে প্রথমেই সুস্থ সবল ভালো ফলন দেখে ফসল নির্বাচন করতে হবে। এরপর কেটে, মাড়াই-ঝাড়াই করার পর রোদে ভালোমতো শুকাতে হবে। শুকানো গরম ধান ঝেড়ে পরিষ্কার করে ছায়ায় রেখে ঠাণ্ডা করে বায়ুরোধী পাত্রে সংরক্ষণ করতে হবে। বীজ রাখার পাত্রটিকে মাটি বা মেঝের উপর না রেখে পাটাতনের উপর রাখতে হবে। পোকার উপদ্রব থেকে রেহাই পেতে ধানের সাথে নিম, নিসিন্দা, ল্যান্টানার পাতা শুকিয়ে গুঁড়া করে মিশিয়ে দিতে হবে।
গম
কার্তিক মাসের দ্বিতীয় পক্ষ থেকে গম বীজ বপনের প্রস্তুতি নিতে হয়। দো-আঁশ মাটিতে গম ভাল হয়। অধিক ফলনের জন্য গমের আধুনিক জাত যেমন- বারি গম-২৫, বারি গম-২৮, বারি গম-২৯, বারি গম-৩০, বারি গম-৩১, বারি গম-৩২, বারি গম-৩৩ এবং লবণাক্ততাসহিষ্ণু বিনা গম-১ রোপণ করতে পারেন। বীজ বপনের আগে অনুমোদিত ছত্রাকনাশক দিয়ে বীজ শোধন করে নিতে হবে। সেচযুক্ত চাষের জন্য বিঘাপ্রতি ১৬ কেজি এবং সেচবিহীন চাষের জন্য বিঘা প্রতি ১৩ কেজি বীজ বপন করতে হবে। ইউরিয়া ছাড়া অন্যান্য সার জমি তৈরির শেষ চাষের সময় এবং ইউরিয়া তিন কিস্তিতে উপরি প্রয়োগ করতে হবে। বীজ বপনের ১৩-২১ দিনের মধ্যে প্রথম সেচ প্রয়োজন এবং এরপর প্রতি ৩০-৩৫ দিন পর ২ বার সেচ দিলে খুব ভালো ফলন পাওয়া যায়।
আখ
এখন আখের চারা রোপণের উপযুক্ত সময়। ভালোভাবে জমি তৈরি করে আখের চারা রোপণ করা উচিত। আখ রোপণের জন্য সারি থেকে সারির দূরত্ব ৯০ সেমি. থেকে ১২০ সেমি. এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব ৬০ সেমি. রাখতে হয়। এভাবে চারা রোপণ করলে বিঘাপ্রতি ২২০০-২৫০০টি চারার প্রয়োজন হয়।
ভুট্টা
ভুট্টা চাষ করতে চাইলে এ সময় যথাযথ প্রস্তুতি নিতে হবে এবং জমি তৈরি করে বীজ বপন করতে হবে। ভুট্টার উন্নত জাতগুলো হলো খই ভুট্টা, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৯, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৪, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৫, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৬, বারি মিষ্টি ভুট্টা-১, বারি বেবি কর্ন-১ এসব। খরা প্রধান এলকা ও সাদা দানার ক্ষেত্রে বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১২ ও বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৩ আবাদ করতে পারেন।
সরিষা ও অন্যান্য তেল ফসল
কার্তিক মাস সরিষা চাষেরও উপযুক্ত সময়। সরিষার প্রচলিত স্বল্পমেয়াদি জাতগুলোর মধ্যে বারি সরিষা-১৪, বারি সরিষা-১৫, বারি সরিষা-১৭, বিনাসরিষা-৪. বিনাসরিষা-৯ ইত্যাদি এবং দীর্ঘমেয়াদি জাতগুলোর মধ্যে বারি সরিষা-১১, বারি সরিষা-১৬ উল্লেখযোগ্য। জাতভেদে সামান্য তারতম্য হলেও বিঘাপ্রতি গড়ে ১ থেকে ১.৫ কেজি সরিষার বীজ প্রয়োজন হয়। বিঘাপ্রতি ৩৩-৩৭ কেজি ইউরিয়া, ২২-২৪ কেজি টিএসপি, ১১-১৩ কেজি এমওপি, ২০-২৪ কেজি জিপসার ও ১ কেজি দস্তা সারের প্রয়োজন হয়। সরিষা ছাড়াও অন্যান্য তেল ফসল যেমন- তিল, তিসি, চিনাবাদাম, সূর্যমুখী এ সময় চাষ করা যায়।
আলু
আলুর জন্য জমি তৈরি ও বীজ বপনের উপযুক্ত সময় এ মাসেই। হালকা প্রকৃতির মাটি অর্থাৎ বেলে দো-আঁশ মাটি আলু চাষের জন্য বেশ উপযোগী। আগামজাত ও ভালো ফলনের জন্য যে জাতগুলো উপযুক্ত তাহলো বারি আলু-১৩ (গ্রানোলা), বারি আলু-২৯ (কারেজ), বারি আলু-৪১, বারি আলু-৭৪ (বারসেলোনা) এবং প্রক্রিয়াজাতকরণ ও খাবার উপযোগী হিসেবে বারি আলু-২৫, বারি আলু-২৮, বারি আলু-৩৫, বারি আলু-৩৬, বারি আলু-৪৬, বারি আলু-৭৬, বারি আলু-৭৭, বারি আলু-৭৮, বারি আলু-৭৯ ইত্যাদি এসব। প্রতি একর জমি আবাদ করতে ৬০০ কেজি বীজ আলুর দরকার হয়। এক একর জমিতে আলু আবাদ করতে ১৩০ কেজি ইউরিয়া, ৯০ কেজি টিএসপি, ১০০ কেজি এমওপি, ৬০ কেজি জিপসাম এবং ৬ কেজি দস্তা সার প্রয়োজন হয়। তবে এ সারের পরিমাণ জমির অবস্থাভেদে কম-বেশি হতে পারে। তাছাড়া একরপ্রতি ৪-৫ টন জৈবসার ব্যবহার করলে ফলন অনেক বেশি পাওয়া যায়। আলু উৎপাদনে আগাছা পরিষ্কার, সেচ, সারের উপরিপ্রয়োগ, মাটি আলগাকরণ বা কেলিতে মাটি তুলে দেয়া, বালাই দমন, মালচিং করা আবশ্যকীয় কাজ। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সাথে সাথে বিনা চাষে মালচিং দিয়ে আলু আবাদ করা যায়।
মিষ্টি আলু
নদীর ধারে পলি মাটিযুক্ত জমি এবং বেলে দো-আঁশ প্রকৃতির মাটিতে মিষ্টি আলু ভালো ফলন দেয়। কমলা সুন্দরী, বারি মিষ্টি আলু-৪, বারি মিষ্টি আলু-৫, বারি মিষ্টি আলু-৮, বারি মিষ্টি আলু-১১, বারি মিষ্টি আলু-১২, বারি মিষ্টি আলু-১৪ বারি মিষ্টি আলু-১৫ ও বারি মিষ্টি আলু-১৬ আধুনিক মিষ্টি আলুর জাত। প্রতি বিঘা জমির জন্য তিন গিঁটযুক্ত ২২৫০-২৫০০ খণ্ড লতা পর্যাপ্ত। বিঘাপ্রতি ৪-৫টন গোবর/জৈবসার, ১৬ কেজি ইউরিয়া, ৪০ কেজি টিএসপি, ৬০ কেজি এমওপি সার দিতে হবে।
ডাল ফসল
মুসুর, মুগ, মাসকলাই, খেসারি, ফেলন, অড়হর, সয়াবিন, ছোলাসহ অন্যান্য ডাল এসময় চাষ করতে পারেন। এজন্য উপযুক্ত জাত নির্বাচন, সময় মত বীজ বপন, সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ, পরিচর্যা, সেচ, বালাই ব্যবস্থাপনা সম্পন্ন করতে হবে।
শাকসবজি
শীতকালীন শাকসবজি চাষের উপযুক্ত সময় এখন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বীজতলায় উন্নতজাতের দেশী-বিদেশী ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, শালগম, বাটিশাক, টমাটো, বেগুন এসবের চারা উৎপাদনের জন্য বীজতলায় বীজ বপন করতে হবে। আর গত মাসে চারা উৎপাদন করে থাকলে এখন মূল জমিতে চারা রোপণ করতে পারেন। মাটিতে জোঁ আসার সাথে সাথে শীতকালীন শাকসবজি রোপণ করতে হবে। এ মাসে হঠাৎ বৃষ্টিতে রোপণকৃত শাকসবজির চারা নষ্ট হতে পারে। এ জন্য পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে। রোপণের পর আগাছা পরিষ্কার, সার প্রয়োগ, সেচ নিকাশসহ প্রয়োজনীয় পরিচর্যা করতে হবে। তাছাড়া লালশাক, মুলাশাক, গাজর, মটরশুটির বীজ এ সময় বপন করতে পারেন।
অন্যান্য ফসল
অন্যান্য ফসলের মধ্যে এ সময় পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ, ধনিয়া, কুসুম, জোয়ার এসবের চাষ করা যায়। সাথী বা মিশ্র ফসল হিসেবেও এসবের চাষ করে অধিক ফলন পাওয়া যায়। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সাথে সাথে জমিতে পানি কচু বপন করতে পারেন। সেচ নালা সংস্কার ও মেরামত করতে হবে।
প্রাণিসম্পদ
সামনে শীতকাল আসছে। শীতকালে পোল্ট্রিতে রোগবালাইয়ের আক্রমণ বেড়ে যায়। রানীক্ষেত, মাইকোপ্লাজমোসিস, ফাউল টাইফয়েড, বসন্ত রোগ, কলেরা এসব রোগ দেখা দিতে পারে। এসব রোগ থেকে হাঁস-মুরগিকে বাঁচাতে হলে এ মাসেই টিকা দেবার ব্যবস্থা করতে হবে। গত মাসে ফুটানো মুরগির বাচ্চার ককসিডিয়া রোগ হতে পারে। রোগ দেখা দিলে সাথে সাথে চিকিৎসা করাতে হবে।
গবাদিপ্রাণির আবাসস্থল মেরামত করে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। গবাদি প্রাণীকে খরের সাথে তাজা ঘাস খাওয়াতে হবে। ভুট্টা, মাসকালাই, খেসারি রাস্তার ধারে বা পতিত জায়গায় বপন করে গবাদি প্রাণীকে খাওয়ালে স্বাস্থ্য ও দুধ দুটোই বাড়ে। রাতে অবশ্যই গবাদি প্রাণীকে বাইরে না রেখে ঘরের ভিতরে রাখতে হবে। তা না হলে কুয়াশায় ক্ষতি হবে। গবাদি প্রাণীকে এ সময় কৃমির ওষুধ খাওয়াতে হবে। এছাড়া তড়কা, গলাফুলা রোগের বিষয়ে সচেতন থাকলে মারাত্মক সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়া যাবে।
মৎস্যসম্পদ
এ সময় পুকুরে আগাছা পরিষ্কার, সম্পূরক খাবার ও সার প্রয়োগ করতে হবে। জাল টেনে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাও জরুরি। রোগ প্রতিরোধের জন্য একরপ্রতি ৪৫-৬০ কেজি চুন প্রয়োগ করতে পারেন। অংশদারিত্বের জন্য যেখানে যৌথ মাছ চাষ সম্ভব নয় সেখানে খুব সহজে খাঁচায় বা প্যানে মাছ চাষ করতে পারেন।
আরো পড়ুন:
0 Comments