স্ট্রিপ বা কান্দি পদ্ধতিতে আন্তঃফসল চাষ |
ফসলের মাঠ বা বাড়ির পাশের, ব্যাকইয়ার্ডের বাগানে সবখানে একটি স্বাস্থ্যকর বাস্তুসংস্থান নির্ভর করে মূলত মাটিতে বসবাসরত অনুজীবগুলোর পারস্পরিক সহযোগিতামূলক সহাবস্থান যা পরিবেশকে একটি ভারসাম্য দেয়। আধুনিক কৃষিতে কিন্তু এই ভারসাম্যের বিষয়টিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। যদিও উন্নত কৃষি বলতে বুঝায় উচ্চফলনশীল জাত এবং এক ফসলী মৌসুম। কিন্তু এই একটি মৌসুমে জমিতে বছর বছর একটি মাত্র ফসল আবাদের ফলে ফসলের পাশাপাশি মাটিতেও দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা তৈরি হয়। বিশেষ করে ফসলে নিয়ন্ত্রিত অযোগ্য পোকামাকড় ও রোগবালাইয়ের আক্রমণ। এতে করে এক সময় ফসলে ফলন কমতে থাকে, বাড়তে থাকে উৎপাদন খরচ। একসময় গিয়ে ঘটে ফলন বিপর্যয়।
এই এক ফসলি কৃষি ব্যবস্থার ফলে সৃষ্ট সমস্যার মোকাবেলা করতে এখন ভাবা হচ্ছে এমন এক টেকসই কৃষি প্রযুক্তি যেখানে থাকে একটি বৈচিত্র্যপূর্ণ জৈব উৎপাদন ব্যবস্থা। এর মধ্যে একটি অতি সাধারণ এবং প্রচলিত পদ্ধতি হচ্ছে আন্তঃফসল বা ইন্টারক্রপিং (intercropping)। আন্তঃফসল পদ্ধতি হলো একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে একই জমিতে দুটি বা তার বেশি ফসল আবাদ করা। আন্তঃফসলের চারটি ধরন রয়েছে:
স্ট্রিপ: সোজা বাংলায় বলা যেতে পারে ডারা বা কান্দি করে ফসল আবাদ। এ পদ্ধতিতে একটি জমিতে কান্দি করে একেকটিতে একেক ফসল আবাদ করা হয়।
সারি: একাধিক ফসল একসঙ্গে আবাদ করা হয়। এক সারিতে কমপক্ষে একটি ফসল থাকে।
মিশ্র: এই পদ্ধতিতে কোনো নিয়মকানুন নেই। ছিটিয়ে বা গোলাকার কান্দি করে করে বা সুবিধামতো একাধিক ফসল আবাদ করা হয়।
রিলে বা অনুসারী: এই পদ্ধতিতে একসঙ্গে একাধিক ফসল আবাদ করা হয় তবে একটি ফসলের জীবনচক্রের শেষের দিকে অপর ফসল জমিতে বোনা হয়। সাধারণভাবে বললে, আন্তঃফসলের দ্বিতীয় ফসলটি বোনা হয় তখনই যখন প্রথম ফসলটিতে ফল আসার সময় হয়ে যায় এবং সেটি পরিপক্বতার শেষ ধাপে থাকে।
বড় আকারের খামারে স্ট্রিপ বা কান্দি এবং সারি পদ্ধতিই বেশি অনুসরণ করা হয়। কারণ এতে করে ফসল সংগ্রহ সহজ হয়। আন্তঃফসলের ক্ষেত্রে একটা বিষয় মনে রাখা দরকার- এখানে ফসলের মানের ওপর যতোটা না গুরুত্ব দেওয়া হয় তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হয় লাভের দিকে। অর্থাৎ আন্তঃফসল হিসেবে কোনটা বেছে নিবেন সেটি নির্ভর করবে তাতে লাভ কতোটা। এতে ফসলের কোয়ালিটি অতোটা বিবেচ্য নয়। সোজা কথায়, আন্তঃফসল হওয়া উচিত ছোট খামারিদের কম জায়গায় বেশি ফসল ফলিয়ে পরিবারের চাহিদা মেটানোর কৌশল।
আন্তঃফসল প্রযুক্তি ব্যবহার করতে চাইলে, জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। আর জমি ও ফসলের পরিচর্যা করতে হবে নিজ হাতে। এখানে শ্রমিক বা যন্ত্র ব্যবহার না করাই ভালো। কারণ একই জমিতে আলাদা কয়েক ধরনের ফসল থাকায় পরিচর্যা ও ফসল সংগ্রহের সময় সতর্ক থাকা দরকার যাতে অন্য ফসল ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
সাথি ফসল
এবার আসা যাক সাথি ফসলের প্রসঙ্গে। এই পদ্ধতিতে ফসলের ধরন বাছাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ধরন বাছাইয়ে ভুল করলে পুরো পরিশ্রমই মাঠে মারা যাবে। এই প্রযুক্তির মূলে আছে বিভিন্ন ফসলের মধ্যে মিথোজীবী (সিম্বায়োটিক) সম্পর্ক। এখানে আন্তঃফসলের ডারা, কান্দি বা সারির মতো গুছিয়ে ফসল বোনার কোনো ব্যাপার নেই। সাথি ফসলের ডিজাইনটিই এমনভাবে করা হয় যেন এক ফসল আরেক ফসলকে পুষ্টি ও নিরাপত্তার দিকে থেকে সহযোগিতা করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, পোকামাকড় ও বালাই প্রতিরোধক, গোড়ার মাটিতে নাইট্রোজেন জুগিয়ে বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করা, উজ্জ্বল সুবাসযুক্ত ফুল পরাগায়নের জন্য মৌমাছি বা অন্যান্য পোকামাকড় আকর্ষণ করা ইত্যাদি।
অবশ্য আধুনিক বাণিজ্যিক কৃষিতে সাথি ফসল প্রযুক্তিটি তেমন আর ব্যবহৃত হয় না। কিন্তু আজকাল জৈবকৃষি বা অর্গানিক ফসলের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে এবং সেই সঙ্গে মানুষও পরিবেশ সচেতন হয়ে উঠছে ফলে সাথি ফসল প্রযুক্তিও ছোট পরিসরে হলেও সারা দুনিয়াতে চর্চা শুরু হয়ে গেছে। এছাড়া যেখানে ফসল ফলানো একটি চ্যালেঞ্জ, নিয়মিত যথেষ্ট পুষ্টি সরবরাহের ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতা রয়েছে সেসব এলাকায় সাথি ফসলই কৃষি প্রযুক্তির প্রধান অবলম্বন হয়ে উঠছে। এছাড়া সারা পৃথিবীতেই ব্যাকইয়ার্ড গার্ডেনাররা সাথি ফসল প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন।
মজার ব্যাপার হলো, আন্তঃফসল প্রযুক্তির মধ্যে সাথি ফসলের সমন্বয় করা সম্ভব। যেমন ভুট্টার সাথে খেসারি বা মাসকলাই চাষ। এ কারণেই সাথি ফসল চাষকে আন্তঃফসলেরই একটি ধরন বললেও ভুল হবে না।
আন্তঃফসলের প্রচলিত চারটি প্যাটার্নের (সারি, কান্দি, মিশ্র ও অনুসারী বা রিলে) মধ্যে কোনোটিতে যদি সাথি ফসল চাষ করা হয় তাহলে সেটিকে আলাদা একটি নাম দেওয়া যেতে পারে।
যেমন, বালাইনাশক আন্তঃফসল বলতে বোঝায় নির্দিষ্ট কোনো পোকামাকড় বা ক্ষতিকর অণুজীবের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী ক্ষমতা আছে এমন ফসলের জাত ব্যবহার করা। আরেক ধরনের পদ্ধতি আছে যেটিকে বলে ফাঁদ ফসল। এ পদ্ধতিতে একটি থাকে প্রধান ফসল আর আরেকটি সহায়ক ফসল। প্রধান ফসল ও সহায়ক ফসল পাশাপাশি দুটি সারি বা কান্দিতে লাগানো হয়। সহায়ক ফসলটি হয় বিশেষ ধরনের পোকামাকড়ের প্রতি আকর্ষণীয়। অথবা একই ফসলের এমন জাত যা পোকামাকড়কে আকর্ষণ করে। এছাড়া ওই সহায়ক ফসলটি মূল ফসলটির আগেই এমন পরিপক্বতা অর্জন করে যা পোকামাকড়ের প্রতি আকর্ষণীয়। ফলে পোকামাকড় আক্রমণ করলে সহায়ক ফসলটিতে করে। এর মধ্যে মূল ফসলটি পরিপূর্ণভাবে পরিপক্ব হয়ে যায়। ফলে পোকামাকড় থেকে রক্ষা পায়। এ জন্যই এটিকে বলে ফাঁদ ফসল।
আরো পড়ুন:
0 Comments