গরু মোটাতাজাকরণ খামারিরা একটি সস্তা এবং সহজলভ্য বিকল্প গোখাদ্য উৎস হিসেবে সাধারণত ধানের খড়ের ওপর ভরসা করেন। তবে ইদানীং অনেক সচেতন খামারি দানাশস্য যেমন, গম, যব/বার্লি, খেসারি বা মটর খড় খাওয়ানো শুরু করেছেন। কিন্তু এসব দানাশস্যের খড়ই একমাত্র বিকল্প নয়।
প্রাণী পুষ্টিবিদরা বলছেন, ক্যানোলা বা সরিষার খড় কেবল গরুর জন্য উপযুক্ত খড়ই নয়, এটিতে রয়েছে গম বা বার্লির খড়ের চেয়েও বেশি প্রোটিন। এটি ক্যালসিয়ামেরও একটি ভালো উৎস।
সরিষা আমাদের দেশেই উৎপাদিত একটা তেলবীজ। মাঝে আমদানি করা সয়াবিনে বাজার সয়লাব হয়ে যাওয়ার কারণে সরিষা প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছিল। তবে বিশেষ করে শহরে সরিষার তেলের চাহিদা বাড়তে শুরু করেছে। ফলে সারাদেশে শীতকালে প্রচুর সরিষা চাষ করা হচ্ছে।
সরিষা পাকলে গাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করার পরে আমরা সাধারণত খোসা (ছিঁ) এবং শুকনো গাছগুলো জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করি। অথবা অনেকে ফেলে দেয়। বড়জোর জৈবসার হয়। কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না বীজ সংগ্রহ করার পরে অবশিষ্ট শুকনা অংশ পুষ্টি গুণে সমৃদ্ধ। এই সরিষা গাছ হতে পারে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিকল্প গোখাদ্য।
বিশেষ করে খরা, বন্যা বা যখন ঘাসের ঘাটতি দেখা দেয়, তখন শুকনো সরিষা গাছ বা খড় গম, বার্লি বা রাইয়ের পরিবর্তে সরিষা গাছ ব্যবহার করা যেতে পারে। তাছাড়া গরু কিন্তু সরিষা গাছ ও খোসা খেতেও পছন্দ করে। যদিও প্রথম প্রথম অভ্যস্ত করতে দুই থেকে তিন দিন সময় লেগে যেতে পারে।
দানাশস্যের খড়ের চেয়ে শুকনো সরিষা গাছের অনেকগুলো সুবিধা রয়েছে। এটি সহজে সংরক্ষণ করা যায়। সরিষা গাছের মধ্যে সাধারণত ৬ থেকে ৭ শতাংশ প্রোটিন থাকে। যেখানে গমের খড়ে ৪ বা ৫ শতাংশ এবং বার্লি বা ওট খড়ে ৫ বা ৬ শতাংশ প্রোটিন রয়েছে।
অবশ্য খড় বা ঘাসে ৭ বা ৮ শতাংশের মধ্যে প্রোটিনের আদর্শ মাত্রা হিসাব করলে এ তালিকার শীর্ষে রয়েছে মটরশুঁটির খড়।
সরিষা গাছে দানাশস্যের খড়ের তুলনায় ক্যালসিয়ামের মাত্রা চার থেকে পাঁচগুণ বেশি।বিশেষ করে খামারে ব্রিডার (বংশবৃদ্ধির জন্য ব্যবহৃত) বা দুধ দেওয়া গরুর জন্য ক্যালসিয়াম একটি গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান।
সরিষার গাছে ক্যালসিয়ামের মাত্রা সাধারণত ১.২ থেকে ১.৪ শতাংশ পর্যন্ত থাকে। আর ওট এবং বার্লির খড়ে ক্যালসিয়ামের মাত্রা সাধারণত ০.২ থেকে ০.২৫ শতাংশ।
ফলে ডায়েটে পর্যাপ্ত ক্যালসিয়াম পেতে যদি সমস্যা হয় বা খরচ বেড়ে যায় তবে এই সরিষা গাছের অতিরিক্ত ক্যালসিয়াম সত্যিই সহায়ক হবে।
সরিষার গাছে দানাশস্যের খড়ের চেয়ে অনেক বেশি ক্যালসিয়াম পাওয়া যায়, ফলে খামারে ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্ট হিসেবে কম চুনাপাথর (লাইমস্টোন) সরবরাহ করতে হয়।
গরু বা বাছুরের জন্য আদর্শ রেশনে (স্ট্যান্ডার্ড রেশন) ফসফরাসের দ্বিগুণ ক্যালসিয়াম থাকে। যেখানে ক্যালসিয়ামের মাত্রা কম থাকে, সেখানে লাইমস্টোন দেওয়া যেতে পারে। তবে লাইমস্টোন শুকনো, খড়িযুক্ত এবং খুব একটা সহজপাচ্য নয়। সেক্ষেত্রে সরিষা গাছ একটা চমৎকার বিকল্প।
সরিষার গাছ সহজলভ্য ও সহজে হজমযোগ্য। এটি সাপ্লিমেন্টারি ক্যালসিয়ামের একটি ভালো বিকল্প।
তবে শীতকালীন রেশনে যেকোনো ধরনের খড় যুক্ত করার সময় সচেতন থাকতে হবে।
সরিষার গাছ এবং এ ধরনের অন্যান্য খড়ের বেশিরভাগের মধ্যে উচ্চ মাত্রার নিউট্রাল ডিটারজেন্ট ফাইবার (এনডিএফ) থাকে। এই এনডিএফ হজমের গতি কমিয়ে দেয়।
সুতরাং এনডিএফ-এর মাত্রা বাড়ার সাথে সাথে ব্যাকটেরিয়া এবং এনজাইমের পক্ষে সেই ফিডটি ভেঙে ফেলা (হজম) আরও কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে তারা দীর্ঘ সময় ধরে রুমেনে অবস্থান করে।
অত্যধিক এনডিএফ ফিড গ্রহণের কারণে ওজন হ্রাস এবং গুরুতর ক্ষেত্রে রুমেন সংকোচন এবং এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। রুমেনের কাযকারিতা কমে গেলে প্রোটিনের ঘাটতি দেখা দিতে পারে।
একটি সুষম রেশনে সরিষার গাছ ড্রাই ম্যাটারের ভিত্তিতে (পানি বাদে শুষ্ক পদার্থ) গরুর দেহের ওজনের ১.২৫ থেকে ১.৫ শতাংশ দেওয়া যেতে পারে।
অর্থাৎ ১৪০০ পাউন্ড বা ৬৩৫ কেজি ওজনের গাভীর জন্য সরিষার গাছ প্রতিদিন ৮ থেকে ৯ কেজি দেওয়া যেতে পারে।
মনে রাখতে হবে, যে কোনও ধরনের স্ট্র বা খড়ে প্রোটিন এবং শক্তি তুলনামূলক কম থাকে।
সে কারণে, রুমেন সুস্থ রাখতে দানাদার খাদ্য, সাইলেজ বা অন্যান্য প্রোটিন জাতীয় খাবারও পরিমান মতো দিতে হবে।
খাওয়ানোর নিয়ম
সরিষা জমি থেকে সংগ্রহের সময় যদি গাছ উপড়ে তোলা হয় তাহলে, বীজ সংগ্রহ করার পরে অবশিষ্ট শুকনা গাছের গোড়ার শক্ত অংশ কেটে ফেলে দিতে হবে। এবার নরম অংশ এবং খোসা ভালো করে রোদে শুকিয়ে সংরক্ষণ করে সারা বছর খাওয়ানো যেতে পারে।
শুকনা সরিষা গাছের নরম অংশ কুচি করে কেটেও গরুকে খাওয়ানো যেতে পারে। শুরুতে নতুন স্বাদের কারণে গরু খেতে না চাইলে পানি মিশিয়ে নরম করে অল্প অল্প করে অভ্যাস করলে এরপর মজা করেই খাবে। শুধু সরিষা গাছ ও খোসা খেতে না চাইলে কুচি করে কেটে সামান্য চিটাগুড় মেখে নরম করে দেওয়া যেতে পারে। এভাবে চেষ্টা করলে দুতিন দিনের মধ্যে অভ্যাস হয়ে যাবে।
পুষ্টি উপাদান
শুকনা সরিষা গাছ এবং খোসায় রয়েছে ৬-৮% ক্রুড প্রোটিন, যেখানে ধানের খড়ে আছে ৪-৫%, ওট স্ট্রতে ৫-৬% এবং ভুট্টার হে-তে ৫%। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, সরিষা স্ট্রতে ক্যালসিয়ামের পরিমান ধানের খড়, ওট, বার্লি বা ভুট্টা স্ট্রর চেয়ে ৩ থেকে ৪ গুন বেশি। ভুট্টার হে-তে ক্যালসিয়ামেরে পরিমান যেখানে ০.২৫-০.৩%, সেখানে সরিষা গাছে ক্যালসিয়ামের পরিমান ১.২-১.৪%। সরিষা স্ট্র’র মোট হজমযোগ্য পুষ্টি উপাদান ৫০-৫৫% ।
মাত্রা ও সাবধানতা
সারাদিনের মোট ড্রাই ম্যাটারের ৪০% অথবা লাইভ ওয়েটের ১.০-১.২৫% এর বেশি সরিষা গাছ দেওয়া যাবে না।
0 Comments