সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

গবাদিপশুর ক্ষুরের যত্ন নেওয়া যে কারণে জরুরি

cattle hoof trimming
ইলেকট্রিক ট্রিমার দিয়ে ক্ষুর কাটা।

গরু ছাগলসহ যে কোনো গবাদিপশুর সুস্বাস্থ্য এবং উৎপাদনশীলতা অনেকখানি নির্ভর করে পশুর খুরের স্বাস্থ্যেরে ওপর। কথাটা অনেকের কাছে হাস্যকর বা হেঁয়ালি মনে হতে পারে। কিন্তু শরীরের গঠন সম্পর্কে ভাবলে এই অঙ্গের গুরুত্ব সহজেই বুঝা যাবে। 

মানুষের হাত ও পায়ের তালু, ঠোঁট এসব অঙ্গে সবচেয়ে বেশি স্নায়ু উন্মুক্ত থাকে। ফলে এসব অঙ্গ হয় সবচেয়ে সংবেদনশীল। একই ভাবে গবাদিপশুর সবচেয়ে সংবেদনশীল অঙ্গগুলোর মধ্যে পায়ের ক্ষুর অন্যতম। এই কারণেই এই অংশের সুরক্ষার জন্য রয়েছে বাইরে একটি শক্ত আবরণ। এটিকেই আমরা সাধারণত ক্ষুর বলি। আসলে, ক্ষুর মূলত বাইরের শক্ত আবরণ ও ভেতরের নরম ও সংবেদনশীল অংশ নিয়েই গঠিত। 

এই জন্যই পশুপালনের ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকা দেশগুলোতে ক্যাটল ফার্মিং বা গরুর খামার ব্যবস্থাপনায় হুফ ম্যানেজমেন্ট বা ক্ষুর ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। সেটি দুধ উৎপাদন হোক বা মোটাতাজাকরণ হোক। সর্বোচ্চ উৎপাদন পেতে চাইলে অন্যান্য যত্নের পাশাপাশি এই অঙ্গটির পরিচর্যার দিকেও বিশেষ নজর দিতে হবে। 

ক্ষুর সুরক্ষিত না থাকলে কী কী ঝুঁকি আছে একনজরে দেখে নেওয়া যাক: 

ক্ষুরের নরম অংশ যদি উন্মুক্ত হয়ে পড়ে বা শক্ত আবরণ বড় হয়ে যায় তাহলে সেটি হয়ে উঠতে পারে জীবাণুর আখড়া। সেখান থেকে সহজেই ইনফেকশন (সংক্রমণ) হতে পারে। এমনকি জীবাণু এই নরম অংশ ভেদ করে রক্তে প্রবেশ করে অন্যান্য ইনফেকশন বা রোগও সৃষ্টি করতে পারে। যেমনটি খালি পায়ে থাকলে মানুষের পায়ের তালু ভেদ করে কৃমির ডিম শরীরে প্রবেশ করে অন্ত্রে গিয়ে ডিম ফুটে বড় কৃমি হয়ে উঠতে পারে।

ক্ষুরের শক্ত আবরণ বেশি বড় হয়ে ফেটে যেতে পারে। আবার আঘাতগ্রস্ত ক্ষুরের ভেতরে ঘা বা ক্ষতের সৃষ্টি হতে পারে। সেখান থেকে ঘটতে পারে ভয়ানক সংক্রমণ।

ক্ষুরের শক্ত আবরণের সামনের অংশের অতিরিক্ত বৃদ্ধির কারণে গরুর পায়ে ব্যথা হয়। হাঁটতে সমস্যা হয়। নড়াচড়া চলাফেরায় সমস্যা বা অস্বস্তির কারণে গাভীর দুধ উৎপাদন কমে যায়। আর মোটাতাজা প্রকল্পের গরুর ওজন বৃদ্ধি কমে যায়। 

ক্ষুর ফেটে গেলে ভেতরের নরম অংশ সহজে আঘাতপ্রাপ্ত হয়। সেখান থেকে ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাকের মতো জীবাণুর ইনফেকশন হতে পারে। সেখান থেকে ঘটতে পারে মারাত্মক জটিলতা।

ফুট রট রোগের সৃষ্টি হয় ক্ষুরের অযত্নের কারণেই। ফুট রট (Foot Rot) গবাদিপশুর পায়ের ক্ষুরের চারপাশে ও ক্ষুরের মধ্যবর্তী স্থানের টিস্যুর প্রদাহজনিত একটি ব্যাকটেরিয়া ঘটিত সংক্রামক রোগ। সাধারণত খামারের পরিবেশ স্যাঁতস্যাঁতে থাকলে ও পায়ে ক্ষত থাকলে গরুর ফুট রট রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সব বয়সের পশুই (গাভী, বলদ, ষাঁড়, বকনা ইত্যাদি) এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে।

ক্ষুরের ভেতরের নরম অংশে বিপুল সংখ্যক স্নায়ু উন্মুক্ত থাকে। ফলে এ অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলে গরু পক্ষাঘাতগ্রস্ত বা প্যারালাইজড হয়ে যেতে পারে।

একটি গাভী বা ষাঁড়ের ক্ষুরের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি বা তাতে আঘাতের ফলে সৃষ্ট ইনফেকশন বা প্রদাহের কারণে তাদের শরীরবৃত্তীয় কাজগুলো ব্যাহত হয়। এতে পশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যেতে পারে। এতে পশু সহজেই অন্য রোগের আক্রান্ত হতে পারে। বলাবাহুল্য এতে দুধ ও মাংসের উৎপাদন কমে যাবে।

সোজা কথায় গবাদিপশুর ক্ষুরার যত্ন নেওয়া খুব জরুরি বিষয়। পুরো ব্যবস্থানাটি সংক্ষেপে তুলে ধরার চেষ্টা করা হলো:

১। গরুর ক্ষুর দুই ভাগে বিভক্ত। এই দুভাগের মধ্যে এক দিকের অতি বৃদ্ধির কারণে ঠিক ভাবে দাঁড়াতে বা হাঁটা চলা করতে পারে না এবং এর ফলে ব্যাথা অনুভব করে। তখন এই অতিরিক্ত বৃদ্ধি পাওয়া অংশ ছেঁটে ফেলতে হবে। দরকার হলে এটা দুই বারে করতে হবে।

২। ক্র্যাকড হুফ বা ক্ষুর ফাটা: এই সমস্য যদি গরুতে দেখা দেয় তবে অভিজ্ঞ ভেটেরিনারিয়ানের (পশু চিকিৎসক) শরণাপন্ন হতে হবে।

চিকিৎসাকালীন গরুকে জিংক বা বায়োটিন ইত্যাদি সাপ্লিমেন্ট সরবরাহ করা যেতে পারে, যাতে ফাটার বিস্তার না হয়। এটা নিয়ে অবহেলা করলে ক্ষুর আলগা হয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে। 

৩। ক্ষুরের গঠন দুই স্তর বিশিষ্ট। বাইরের স্তরটি কোনো কারণে আঘাতপ্রাপ্ত হলে বা অতিরিক্ত ঘর্ষণের ফলে ক্ষয়ে গিয়ে অসমান হয়ে গেলে তা ফাইল বা শিরিষ কাগজ দিয়ে ঘষে মসৃণ এবং সমান করে দিতে হবে।

৪। বর্ষাকালে বা আর্দ্র আবহাওয়াতে ক্ষুরের তলার অংশ নরম থাকে, ফলে তখন সহজেই অল্প আঘাতে সেখানে প্রদাহ বা ইনফেকশনের সৃষ্টি হতে পারে। তাই ওই সময়ে যাতে গরুর পায়ের নিচের মাটি শুষ্ক এবং মোলায়েম হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। এক্ষেত্রে রাবারের ম্যাট ব্যবহার করা যেতে পারে।

৫। গরুর ক্ষুরের তলায় অবাঞ্ছিত ময়লা যেমন, গোবর, পচা কাদামাটি ইত্যাদি নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। এ থেকে অনেক সময় ইনফেকশন হয়। তাছাড়া গরুর ক্ষুর দু-এক দিন পর পর অ্যান্টিসেপটিক (জীবাণুনাশক) দিয়ে ধুয়ে দিতে পারলে ভালো হয়।

ক্ষুরে সাধারণত যে ধরনের সমস্যা হয়

ক্ষুরের অতিরিক্ত বৃদ্ধি (Hoof Over growth)

ক্ষুরের প্রাচীর ফেটে যাওয়া (Hoof wall fissures)

ক্ষুরের তলা দিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত বস্তু বা জীবাণু প্রবেশ করা

ল্যামিনিটিস (ক্ষুরের প্রাচীরের সঙ্গে প্যাডাল বোন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এর রোগ সাধারণত ঘোড়া, গাধা, খচ্চর এসব অবিভক্ত ক্ষুরের পশুর বেশি হয়)

গোড়ালির ক্ষয় (Heel erosions)

ক্ষুরের তলা দুই ভাগে বিভক্ত হওয়া

ঘা

ক্ষুর অতিরিক্ত বৃদ্ধি পাওয়া

একেবারে আবদ্ধ অবস্থায় এবং শুষ্ক পরিবেশে পশু পালন করলে পায়ের ক্ষুর স্বাভাবিক ভাবে ক্ষয় হওয়ার সুযোগ পায় না। তখন অতিরিক্ত বৃদ্ধি পায়। ক্ষুর অতিরিক্ত বৃদ্ধি পেলে, ক্ষুর বিকৃত আকার ধারণ করে এবং ক্ষুরের দেয়াল ও ক্ষুরের গোড়ার দিকে তলা বড় হয়ে যায়।  অতিরিক্ত শুষ্ক পরিবেশে গাভী বা ষাঁড় লালন পালন করলে ক্ষুর সহজেই শক্ত হয়ে যায়। শক্ত হওয়ার ফলে ক্ষুর স্বাভাবিক ক্ষয় না হয়ে সামনের দিকে বেঁকে যেতে থাকে। 

ক্ষুর অতিরিক্ত ক্ষয় হওয়া

অনেকের ধারণা, পশুকে পর্যাপ্ত পরিমানে আঁশ জাতীয় খাবার না দিয়ে শুধু উচ্চ মাত্রায় ক্যালরিযুক্ত দানাদার খাদ্য খাওয়ালে ক্ষুর স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি নরম হয়ে যায়। এর ফলে ক্ষুর খুব সহজে ক্ষয়ে যায়, ভেঙে যায়, ধসে যায় এবং আঘাত প্রাপ্ত হয়। অবশ্য খুব ঘন ঘন পানি দিয়ে ক্ষুর ভেজালে বা সব সময় ভেজা, গোবরে, কাদাযুক্ত স্থানে রাখলে নরম ও ভঙ্গুর হতে পারে। জিংকের অভাব হলেও এমন হতে পারে।

ক্ষুরের অতিরিক্ত বৃদ্ধি হলে করণীয়

ক্ষুর বড় হয়ে বেঁকে গেলে কেটে দিতে হবে। ক্ষুরের আকার ও আকৃতি বড় হওয়ার ধরনের ওপর ভিত্তি করে ছয় মাস বা এক বছর পরপর দক্ষ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তি বা পশু চিকিৎসককে দিয়ে ক্ষুরেরর বাড়তি অংশ কেটে ফেলতে হবে। নিজে ক্ষুর কাটতে (Hoof trimming) চাইলে বিশেষ কিছু অস্ত্রপাতির দরকার হবে: হুফ নাইভস বা ক্ষুর কাটার জন্য বিশেষ চাকু রয়েছে, ত্রিকোণাকৃতির ফাইল, চেইন ’স ফাইল- এসব অবশ্যই লাগবে। আজকাল ইলেকট্রিক হুফ ট্রিমিং মেশিন পা্ওয়া যায়। এটি দিয়ে সহজেই ক্ষুর কাটা যায়।

hoof trimming tools
ক্ষুর কাটার যন্ত্রপাতি।

ক্ষুর সুস্থ রাখার উপায়

১. প্রতিদিন ষাঁড় বা গাভীকে গোসল করানোর সময় পায়ের ক্ষুর ব্রাশ দিয়ে পরিষ্কার করে দিতে হবে।

২. ষাঁড় বা গাভীকে ব্যয়ামের ব্যবস্থা করতে হবে অর্থাৎ, দৈনিক যেন ২ ঘণ্টা করে হাঁটাচলা করতে পারে এমন ব্যবস্থা রাখা দরকার।

৩. গরু রাখার জন্য সঠিক নিয়মে মেঝে তৈরি করতে হবে। যাতে প্রসাব ও পানি আটকে না থাকে। নিয়মিত গোবর পরিষ্কার করতে হবে। ঘরের মেঝে কাদা মুক্ত রাখতে হবে।

৪. আবদ্ধ, নিবিড় ও শুষ্ক পরিবেশে ষাঁড় বা গাভী লালন পালন না করা ভালো।

৫. ক্ষুর যাতে সব সময় ভেজা না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

৬. আঁশ জাতীয় খাবার যেমন ঘাসের ব্যাপক সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে এবং মাত্রাতিরিক্ত দানাদার খাবার দেওয়া যাবে না।

৭. ফুট বাথ (Foot bath) ব্যবহার করে গাভীর পায়ের ক্ষুর সুস্থ রাখা যায়।

পুট বাথ সলিউশন: ১০% জিঙ্ক সালফেট, ১০% কপার সালফেট, ৫% ফরমালডিহাইড এবং পানি।

Post a Comment

0 Comments