সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

বাঁশ চাষে ভাগ্য খুলবে

আধুনিক পদ্ধতিতে বাঁশ চাষ

এক সময় বাংলাদেশের প্রায় সব পরিবারেরই দুয়েকটা বাঁশঝাড় ছিল। জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং অন্যান্য ফসল লাভজনক হওয়ায় এখন আর তেমন নেই। তবে পার্বত্য জেলাগুলোতে প্রচুর বাঁশ ঝাড় আছে। মূলত এই পাহাড়ি বাঁশই দেশের চাহিদার সিংহভাগ পূরণ করছে। 

বাঁশ শুধু ঘর-বাড়ি বানানো আর বিভিন্ন পাত্র, মাছ ধরার সরঞ্জাম বানানোর কাজেই লাগে না; বাঁশ ঝাড় প্রাকৃতিক ঝড়/ টর্নেডো/ সাইক্লোন থেকেও আমাদের রক্ষা করে। 

এর বাইরে কাগজ, প্লাইউড, পার্টিকেল বোর্ড, সিমেন্ট বন্ডেড পার্টিকেল বোর্ড তৈরিতে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। 

তবে বাঁশের প্রধান চাহিদা নির্মাণ খাতে। বিশেষ করে ছোটখাট ঠিকাদাররা ভবন নির্মাণের জন্য প্রচুর বাঁশ ব্যবহার করেন। মূলত এই খাতের ব্যাপক চাহিদার কারণেই এখন বাঁশের বেশ দাম। এ কারণে এখন অনেকেই বাঁশের বাণিজ্যিক চাষ করার চেষ্টা করছেন। অনেকের সফলতার গল্প বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এসেছে।

বাঁশের জাত

পৃথিবীতে প্রায়ই ৩০০ প্রজাতির বাঁশ রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ২০ প্রজাতির বাঁশ আমাদের দেশে এলাকাভিত্তিক রয়েছে। যেমন- বড়বাঁশা, মাতলা তল্ল্যা, উড়া, কাঞ্চন, মুলাই, করমজাসহ, বরাগ, রফাই, বাজালি, মৃতিঙ্গা ইত্যাদি। আর আমাদের গবেষকদের উদ্ভাবিত বাঁশসহ দেশে এখন মোট ৩৩ প্রজাতির বাঁশ আছে। বাঁশ ভেদে কাজের ব্যবহারও ভিন্ন হয়ে থাকে।

তবে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে সাত ধরনের বাঁশ বেশি দেখা যায়। এর মধ্যে বরাক, করজবা, বাইজ্জা, তল্লা, মাকলা, ভুদুম অন্যতম। এসব প্রজাতির বাঁশের কাণ্ড পুরু ও কাষ্ঠল বলে ঘরের বেড়া ও খুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া পাকা বাড়ি তৈরির সময় ছাদ ঢালাই দিতেও এসব বাঁশের প্রয়োজন হয়।

সিলেট অঞ্চলে বেশি দেখা যায় তল্লা, মাকলা ও করজবা বাঁশ। চট্টগ্রাম অঞ্চলে বাইজ্জা, যশোর ও খুলনা অঞ্চলে বরাক এবং ময়মনসিংহ অঞ্চলে পাওয়া যায় ভুদুম বাঁশ। এ ছাড়া চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ প্রায় সারা দেশেই মুলি বাঁশের দেখা মেলে। এই বাঁশ রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলার চন্দ্রঘোনায় অবস্থিত কর্ণফুলী কাগজের কলের প্রধান কাঁচামাল।

দেশি জাতের মধ্যে ‘ভুদুম বাঁশ’ সবচেয়ে বড় ও সুউচ্চ। এ বাঁশটির উচ্চতা ১৩০ ফুট এবং ব্যাস প্রায় দুই ফুট পর্যন্ত হয়। 

আমাদের দেশে এখন অনেকেই বাণিজ্যিকভাবে বাঁশ চাষের স্বপ্ন দেখে। আর আমাদের দেশের সব এলাকাতেই প্রায় বাঁশ চাষ সম্ভব। সে সুবাধে অনেক গবেষণার ফলশ্রুতিতে এখন ব্যপকভাবে টিস্যু কালচার ও কাটিং পদ্ধতিতে বাঁশ চাষ হচ্ছে।

কাটিং পদ্ধতিতে বাঁশ চাষ খুবই সহজ। একটি পরিণত বাঁশ থেকে ৪০টির মতো চারা কেটে নিয়ে সেগুলো থেকেই চারা তৈরি হয়। সময়মত এই চারা জমিতে আখের মতো করে লাগাতে হয়। এক বা দুইবার সেচ দিলেই বাঁশ বাড়তে শুরু হরে। মাত্র ৩ বছরেই বাড়ন্ত বাঁশে ভরে ওঠে বাঁশবাগান। 

চাঁদপুর, সিলেট, কুমিল্লাসহ বিভিন্ন স্থানে এই পদ্ধতিতে বাঁশের বাণিজ্যিক খামার গড়ে উঠেছে। 

জমি নির্বাচন

সাধারণত ডোবা, নালা, খাল, পুকুর পাড় বা বসতবাড়ির আশপাশে প্রান্তিক জমিতে বাঁশ চাষ করা হয়। দো-আঁশ, এঁটেল দো-আঁশ মাটিতে বাঁশ ভালো হয়।

বাঁশ চাষের জমিটি একটু উঁচু  হতে হবে যেখানে বন্যার পানি জমে না। বাঁশের চারা লাগানোর প্রথম দু’বছর খেয়াল রাখতে হবে যেন কোনো অবস্থাতেই পানি না জমে। বাঁশ বাগান উত্তর-পশ্চিম কোণে হলে ভালো হয়।

এক একর জায়গায় আধুনিক পদ্ধতিতে বাঁশ চাষ শুরু করলে ৫-৬ বছর পর মোটা অংকের রিটার্ন আসতে শুরু করবে।

বাঁশ চাষের আয়-ব্যয় হিসাব

এক একর জায়াগায় ৬-৮ফুট দূরত্বে-দূরত্বে প্রায় ৩০০-৪০০ চারা লাগানো যায়। প্রতিটি চারা প্রায় ৩০-৩৫টাকা পড়তে পারে। তাছাড়া প্রথম দিকে গোবর, সার, লোকবল বাবদ আরও কিছু খরচ হবে। আর পরবর্তীতে তেমন কোন খরচ নাই। যা খরচ হবে তা খুবই সামান্য। অতএব এক একর জায়গায় আনুমানিক ১৫-২০,০০০/- টাকা বা একটু বেশি টাকা খরচ হতে পারে।

 প্রায় দুই বছর পর থেকে এই বাঁশের মুথা বা কান্ড থেকে অসংখ্য বাঁশের জন্ম হয়ে পরবর্তী ৩ বছরের মধ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ বাঁশ বাগানে পরিণত হয়। আর প্রথম দিকে ৪ বছর থেকে কিছু বাঁশ বিক্রয়ের উপযোগী হয় এবং ৫-৬ বছর থেকে নিয়িমিত বাঁশ বিক্রি করা সম্ভব।

আর এভাবে চারা লাগানো পরবর্তী ৫-৬ বছর পর থেকে প্রতিটি ঝাড় থেকে প্রায় ৭-৮টি পূর্ণ বয়সী বাঁশ বিক্রি সম্ভব।ে

সে হিসাবে ৩০০×৭= ২১০০টি বাঁশ বিক্রয় সম্ভব। আর প্রতি পিচ বাঁশ পাইকারি হিসাবে ২০০/- টাকা করে বিক্রি হলে মোট মূল্য দাঁড়ায় ২১০০×২০০= ৪২০,০০০/- টাকা। এভাবে প্রতি বছর বাঁশ বিক্রির পরিমাণ বাড়বে বই কমবে না। 

আর তাছাড়া বাঁশ ঝাড়ের ফাঁকা জায়গাগুলিতে সবজি জাতীয় ফসলও উৎপাদন করা সম্ভব। বিশেষ করে ছায়াতে হয় এমন পাতা জাতীয় ফসল আবাদ করা যেতে পারে।

চারা তৈরি

কাটিং পদ্ধতিতে বাঁশের চারা তৈরি

বাঁশ চাষ করতে চারা তৈরির ক্ষেতে এক থেকে দুই বছর বয়সে বাঁশকে দাবা কলমের মতো মাটিতে শুইয়ে দিতে হয়। বাঁশের গোড়া মাটির ভেতরে থাকবে। এরপর ওই বাঁশের ওপর ভেজা মাটি চাপা দিতে হয়। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে শুইয়ে দিতে হয়। বাঁশের কিছু কিছু গিঁট থেকে নতুন শিকড় ও মোথার জন্ম হয়। সেখান থেকে নতুন বাঁশ বের হয়। বাঁশের চারা গিঁটসহ কেটে উপযুক্ত স্থানে রোপণ করতে হয়।

কঞ্চি থেকে বাঁশের চারা

কঞ্চি থেকে বাঁশের চারা তৈরির পদ্ধতি

বাঁশঝাড় থেকে দুই বছর বয়সী সতেজ ও সবল বাঁশ চিহ্নিত করে কেটে নিতে হবে। বাঁশের কঞ্চিগুলো দুই ইঞ্চি পরিমাণ লম্বা রেখে বাকি অংশ ছেঁটে ফেলে সম্পূর্ণ বাঁশটিকে দুই গিটের মাঝখানে করাতের সাহায্যে বাঁশের আকৃতি ভেদে ৪০ থেকে ৫০ টুকরো করে নিতে হবে। এক বিঘা জমিতে বাঁশের চারা তৈরির জন্য এরকম ৩০০ টুকরোর দরকার হবে। বাঁশ টুকরো করার পর সব টুকরো একটি গর্তের ভেতরে রেখে খড় দিয়ে ঢেকে প্রতিদিন হালকা পানি সেচ দিয়ে ভেজাতে হবে। এরপর পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। এভাবে ১০ থেকে ১৫ দিন রাখার পর দেখা যাবে প্রতিটি গিট থেকে কুশি (নতুন পাতা) বেরিয়েছে। এরপর টুকরোগুলো তুলে নিয়ে নির্ধারিত জমিতে ৮৬ ফিট পরপর নালা কেটে তার মধ্যে বসিয়ে মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। এই মাটি দিয়ে ঢাকার পদ্ধতি হবে আলু চাষের মতো। পরবর্তী ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যেই বাঁশের চারাগাছ কঞ্চির আকারে বেরুতে থাকবে। নজরুল জানান, পুরো বাঁশঝাড় তৈরি হতে এক থেকে দেড় বছর সময় লাগে।

বাঁশের বীজ থেকে চারা তৈরি

বীজ থেকে বাঁশের চারা তৈরি

বাঁশে সারা জীবনে একবার মাত্র ফুল ফোটে। প্রজাতিভেদে ২০ থেকে ১০০ বছর পর বাঁশের ফুল ধরে। ফুল ধরলে বাঁশ ঝাড় মরে যায়। তখন বীজ সংগ্রহ করতে হয়। বীজ সংগ্রহ করে পলিব্যাগে বপন করে চারা উৎপাদন করতে হয়।

গর্ত তৈরি ও সার প্রয়োগ

চারা রোপণের ১৫-২০ দিন আগে নির্বাচিত স্থানে মাটি গর্ত করতে হয়। ৩০ সেমি. গভীর এবং ২০ সেমি. চওড়া গর্ত করতে হবে। সার প্রয়োগ : প্রতি গর্তে পচা গোবব ২ কেজি, টিএসপি ১০ গ্রাম, এমপি ৫ গ্রাম মাটির সাথে মিশিয়ে ১৫-২০ দিন রাখতে হবে।

চারা রোপণ

এক বছর বয়সের চারা ওইগর্তে রোপণ করতে হয়। চারা থেকে চারার দূরত্ব ৫-৬ মিটার দিলে ভালো হয়। সার মিশ্রিত মাটি সরিয়ে সোজা করে গিঁটসহ চারা রোপণ করতে হবে। মোথা থেকে মোথার দূরত্ব ৫-৬ মিটার হলে ভালো হয়। চারা লাগানোর পর গোড়ার মাটি ভালো করে চেপে দিতে হয়।

টিস্যু কালচার করে বাঁশের চারা তৈরি
টিস্যু কালচার করে বাঁশের চারা তৈরি।

বাঁশের পরিচর্যা

খরা হলে নিয়মিত সেচ দিতে হবে। চারার গোড়ায় মাটি তুলে দিয়ে আলগা করে দিতে হয়। কচুরিপানা দিয়ে চারার গোড়া ঢেকে দিলে মাটি ভেজা থাকে। বাঁশ ঝাড় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। কোনো বাঁশ রোগে আক্রান্ত হলে তা মোথাসহ তুলে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। অতিরিক্ত কঞ্চি হলে ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে ছাঁটাই করতে হবে। তিন বছর পর পর বর্ষার পরে ইউরিয়া, টিএসপি ও এমপি সার দিতে হবে। কোনো বাঁশ ঝড়ে ভাঙলে কেটে সরাতে হবে। বাঁশে পোকা আক্রমণ করলে কীটনাশক দিতে হবে।

বাঁশ কাটার সময়

সাধারণত দু’বছর বা তার বেশি বয়সের বাঁশ কাটা উচিত। বনাঞ্চলে সরকারিভাবে সাধারণত তিন বছর অন্তর বাঁশ কাটা হয়। বাঁশ পরিপক্ব হলে বাঁশের কাণ্ডের সবুজ বর্ণ ধূসর হবে। কাণ্ডে টোকা দিলে ধাতব শব্দ হবে। কাটার পর শুকিয়ে কুঁচকে যাবে না।

Post a Comment

0 Comments